যেখানে শোনা যায় পাখির ডাক, শরীর জুড়ায় নির্মল বাতাসে, সেই পরিবেশ আর থাকবে না।

0
328

যেখানে শোনা যায় পাখির ডাক, শরীর জুড়ায় নির্মল বাতাসে, সেই পরিবেশ আর থাকবে না।

সিআরবি বাংলাদেশ রেলওয়ের (পূর্বাঞ্চলীয়) মহাব্যবস্থাপকের নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়। এর পূর্বদিকে  সড়কজুড়ে রয়েছে রেলওয়ে হাসপাতাল, যা ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই হাসপাতালের পাশের খালি জমি, রেলওয়ে হাসপাতাল কলোনি রোড এবং রাস্তার দুইপাশে থাকা প্রায় ৫০টি কর্মচারী কোয়ার্টার নিয়ে মোট ৬ একর জমিতে আরেকটি হাসপাতাল নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। গাছ-গাছালিতে ভরা টাইগারপাস সংলগ্ন পাহাড়ি এই এলাকা। সেই পরিবেশ নষ্ট  করার আয়োজন শুরু হতেই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে চট্টগ্রামের মানুষ। কারণ এখানেই শোনা যায় পাখির ডাক, শরীর জুড়ায় নির্মল বাতাসে। হাসপাতাল হলে আর থাকবে না সেই পরিবেশ।

২০১৩ সালের ১৪ আগস্ট অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির (সিসিইএ) সভায় প্রকল্পটি পিপিপিতে বাস্তবায়নের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। গত বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি পিপিপি প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয় সিসিইএ সভায়। সর্বশেষ ২০২০ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী চূড়ান্ত অনুমোদন দেন। এরপর গত বছরের ১৮ মার্চ ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। তারপর চলতি বছরের শুরুতে নির্ধারিত জমির সামনে প্রকল্পের একটি সাইনবোর্ড টাঙ্গানো হয়।

এই প্রকল্পের পরিকল্পনা ও সহযোগী সংস্থা বাংলাদেশ সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব কর্তৃপক্ষ (পিপিপি)। কার্যনির্বাহী সংস্থা বাংলাদেশ রেলওয়ে এবং বাস্তবায়ন ও পরিচালনা করবে ইউনাইটেড চট্টগ্রাম হাসপাতাল লিমিটেড। প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয়েছে ১২ বছর। প্রকল্পের আওতায় ১০০ আসনের একটি মেডিক্যাল কলেজ, ৫০ আসনের একটি নার্সিং ইনস্টিটিউট এবং দুই ধাপে মোট ৫০০ শয্যার একটি হাসপাতাল নির্মাণ করা হবে। এতে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা খরচ হবে। ৫০ বছর পর প্রকল্পের মালিকানা হবে রেলওয়ের। ইতিমধ্যে প্রজেক্ট ডেভেলপমেন্ট এবং প্রিমিয়াম বাবদ রেলওয়েকে প্রায় ৮ কোটি টাকা পরিশোধও করেছে ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ।

এই চুক্তির প্রতিবাদ জানিয়ে চট্টগ্রামের ১৭ জন জ্যেষ্ঠ নাগরিক এক বিবৃতিতে সিআরবিতে নতুন করে হাসপাতাল নির্মাণ না করার দাবি জানিয়েছেন। চট্টগ্রামের ফুসফুস খ্যাত সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে নগরের অন্য কোনো জায়গায় তা স্থাপনের পদক্ষেপ নিতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ ৮ জনকে লিগ্যাল নোটিশও দেওয়া হয়েছে।

চট্টগ্রামের জ্যেষ্ঠ নাগরিকরা মনে করেন, পাহাড় ও উপত্যকায় গাছপালামণ্ডিত এলাকাটিতে হাসপাতালের কারণে জনসমাগম বৃদ্ধি ও ক্লিনিক্যাল বর্জ্য সিআরবি এলাকার নির্জনতা ও পরিবেশ ঝুঁকিতে ফেলবে। ওই এলাকায় ১৯৩০ সনে চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহীরা অর্থসংগ্রহের জন্যে অভিযান চালিয়েছিল। এছাড়া সিআরবি ভবনটি দেশের ব্রিটিশ স্থাপত্য নিদর্শনের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপত্যকলা। ইতিহাসের ছাত্র-শিক্ষকের শিক্ষা ও গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এসব বিবেচনা থেকেই এলাকাটিকে বাংলাদেশ সরকার সংবিধানের ২য় ভাগের ২৪ ধারা অনুযায়ী ঐতিহ্য ভবন ঘোষণা করে সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করেছে। প্রাকৃতিক কারণে সংবেদনশীল ও ঐতিহাসিক গুরুত্বের স্থানে এধরনের একটি প্রতিষ্ঠান নির্মাণ অনুচিত। চট্টগ্রামে আধুনিক হাসপাতালের প্রয়োজন আছে, তবে তা উপযুক্ত স্থানেই নির্মিত হওয়া বাঞ্ছনীয়।

যদিও এ ব্যাপারে ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক ও রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (সেতু, পূর্ব) আহসান জাবির। তিনি বলেছেন, গত বছরের ১৮ মার্চ সম্পাদিত চুক্তি মোতাবেক ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে হাসপাতালটি নির্মাণ করবে এবং ৫০ বছর পর পুরো হাসপাতাল রেলওয়ের কাছে হস্তান্তর করবে। তখন হাসপাতালটি পুরোপুরি রেলওয়ে হাসপাতাল হিসেবে গণ্য হবে। হাসপাতালে রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিশেষ সুবিধায় চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করতে পারবেন। এর ফলে উন্নত চিকিৎসাসেবার জন্য বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা হ্রাস পাবে।  তিনি দাবি করেন, হাসপাতালটি নির্মাণের জন্য সিআরবি রেলওয়ের নিজস্ব হাসপাতালের পাশে গোয়ালপাড়া এলাকাকে নির্ধারণ করা হয়েছে। সর্বমোট ৬ একর জায়গার উপর হাসপাতালটি নির্মাণ করা হবে। প্রকল্পের জন্য নির্ধারিত স্থানে বর্তমানে রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অতি পুরাতন ও জরাজীর্ণ বাসাবাড়ি রয়েছে। উক্ত স্থানে বসবাসরত কর্মচারী-কর্মকর্তাদের ইতিমধ্যে অন্যত্র বাসা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যারা বাকি রয়েছেন তাদেরকেও পর্যায়ক্রমে অন্যত্র বাসা বরাদ্দ দেওয়া হবে।

প্রকল্প এলাকায় শতবর্ষী কোনো গাছ নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, উক্ত স্থানে বিদ্যমান গাছ এবং ভূমিরূপের অবয়ব ঠিক রেখেই হাসপাতালটি নির্মাণ করা হবে। সিআরবি শিরীষতলা এলাকা ও সাত রাস্তার মোড়ে শতবর্ষী গাছ রয়েছে। ওই স্থানটি এই প্রকল্পের জন্য নির্ধারিত জায়গা নয় বিধায় শতবর্ষী গাছগুলো কাটা বা বিনাশের কোনো আশঙ্কা নেই। শিরীষতলা ও সাত রাস্তার মোড় এলাকায় রেলওয়ে কর্তৃক আরও সৌন্দর্যমণ্ডিত করা হয়েছে। এর ফলে শিরীষতলায় বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানসহ নানাবিধ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। গাছগাছালিতে আচ্ছাদিত নয়নাভিরাম ওই উন্মুক্ত পরিসরটি সকাল-বিকাল মানুষের শরীরচর্চার অন্যতম স্থান হয়ে উঠেছে। গোয়ালপাড়ায় হাসপাতাল নির্মাণ করা হলে সিআরবি এলাকার নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক পরিবেশ ও শিরীষতলায় বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানসহ নানাবিধ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কোনোরূপ প্রতিবন্ধকতা বা বিঘ্ন ঘটবে না।

ক্ষুব্ধ রেলওয়ে শ্রমিক-কর্মচারীদের বিভিন্ন সংগঠন পূর্ব রেলের সদর দপ্তর এলাকায় হাসপাতাল নির্মাণ বন্ধ চেয়ে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবরে স্মারকলিপি দিয়েছে। কর্তৃপক্ষের বক্তব্যে সন্তুষ্ট নয় চট্টগ্রামের সংস্কৃতিপ্রেমীরা। তারা বলছেন, যেভাবেই হোক চট্টগ্রামের ফুসফুস সিআরবিকে বাঁচাতে হবে। পরিবেশ ছাড়পত্রের জন্য সিডিএর অনুমোদন যেন দেওয়া না হয়। কোনও অবস্থাতেই সেখানে এমন প্রতিষ্ঠান গড়তে দেওয়া যাবে না। প্রয়োজনে এই হাসপাতাল ফৌজদারহাট এলাকায় করা যেতে পারে।

একাধিক শতবর্ষী গাছের ছায়া ও অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত সিআরবিকে আগের রূপেই রাখতে চট্টগ্রামের একাধিক বিশিষ্টজনের বিবৃতিসহ আন্দোলনে নামছেন সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাসহ সর্বস্তরের মানুষ। বিশিষ্টজনরা বলছেন, ‘আমরা হাসপাতাল নির্মাণের বিরোধী নই। প্রাকৃতিক কারণে সংবেদনশীল ও ঐতিহাসিক গুরুত্বের স্থানে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান নির্মাণ অনুচিত। চট্টগ্রামে আধুনিক হাসপাতালের প্রয়োজন আছে, তবে তা উপযুক্ত স্থানেই নির্মিত হওয়া বাঞ্ছনীয়।’ জানা গেছে, চট্টগ্রাম নগরীর জনগুরুত্বপূর্ণ সিআরবি, সাত রাস্তার মোড় ও টাইগার পাস ঘিরে থাকা পাহাড় ও উপত্যকায় গাছপালা ঘেরা যে এলাকাটি রয়েছে তা চট্টগ্রামের ফুসফুস হিসেবেই গণ্য হয়। উপকূলবর্তী নদীবেষ্টিত এই পাহাড়ি নগর তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য যুগ যুগ ধরে দেশি-বিদেশি পর্যটক, ঐতিহাসিক, রাজনীতিক ও আগন্তুকদের মনোযোগ ও প্রশংসা কুড়িয়ে আসছে। এ আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্র আলোচ্য নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অপরূপ এলাকাটি। কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণেই নয়, এটি ঐতিহাসিক কারণেও গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। ওই এলাকায় ১৯৩০ সালের ইতিহাস-প্রসিদ্ধ চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহীরা অর্থ সংগ্রহের জন্য অভিযান চালিয়েছিলেন। তদুপরি সিআরবি ভবনটি দেশের ব্রিটিশ বা কলোনিয়াল স্থাপত্যের বিলীয়মান নিদর্শনের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি। হাসপাতালে স্বভাবতই অসুস্থ মানুষের সমাগম ঘটবে, যা এলাকার পরিবেশকে প্রভাবিত করবে। প্রাতঃ ও বৈকালিক ভ্রমণ ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার পাশাপাশি প্রবীণ নাগরিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার অধিকার ক্ষুণ্ন হবে।