পশ্চিমবঙ্গের নাম বদলের প্রস্তাব আবার তুললেন মমতা
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে জিতে আসার পর প্রথমবার দিল্লি এসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে মঙ্গলবার ২৭ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে প্রায় আধঘণ্টা ধরে বৈঠক করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
বৈঠকে পশ্চিমবঙ্গের নামবদলের প্রসঙ্গ প্রধানমন্ত্রীর কাছে তোলেন মমতা। পরে সংবাদ সম্মেলনে বৈঠক ভালো হয়েছে জানিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “প্রধানমন্ত্রী মোদি তার সব কথা শুনেছেন, অনেক দিন হলো বিষয়টি কেন্দ্রের কাছে পড়ে আছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি ভেবে দেখবেন।” রাজ্য পরিচালিত তৃণমূল সরকার পশ্চিমবঙ্গের নামবদল করে বঙ্গ রাখার প্রস্তাব করেছে।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যটির নাম বদল কতটা যুক্তিসঙ্গত? একসময় বামেরা এই প্রস্তাব এনেছিল৷ এখন উদ্যোগী তৃণমূল সরকার৷ প্রতিক্রিয়ায় জোরালো আপত্তি এবং অগ্রাহ্য, দুইই আছে৷
পশ্চিমবঙ্গের নাম বদলে ‘বঙ্গ’, অথবা ‘বাংলা’ করার প্রস্তাব নুতন নয়৷বামফ্রন্ট সরকারের সময় থেকেই এই প্রস্তাব অনেকবারই সামনে এসেছে৷ তার কারণ হিসেবে বলা হতো, ইংরেজিতে রাজ্যের নামের বানান যেহেতু বর্ণমালার শেষদিকের অক্ষর দিয়ে শুরু, রাজ্যগুলির সঙ্গে কেন্দ্রের প্রশাসনিক বৈঠকে পশ্চিমবঙ্গের ডাক আসতে অনেক দেরি হয়ে যায়৷ এবং সব ধরনের সভাতেই শেষ দিকের বক্তারা যেহেতু প্রাপ্য মনোযোগ এবং গুরুত্ব পান না, ভাষণ শুরু হওয়ার আগেই যেন সভা শেষ হয়ে যায়৷ বাম সরকারের আনা এই প্রস্তাবে তখন আপত্তি তুলেছিলেন সে আমলের বিরোধী নেত্রী মমতা ব্যানার্জি৷ এখন ক্ষমতায় এসে তিনিই রাজ্যের নাম বদলে ‘বাংলা’ করায় উদ্যোগী৷ এ সংক্রান্ত প্রস্তাবটি রাজ্য বিধানসভায় তৃণমূল কংগ্রেসের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জেরে পাসও হয়ে গেছে৷ বিষয়টি এখন সংসদে পাস করাতে হবে৷
কিন্তু সমস্যা হলো, কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি এখন এই নামবদলের প্রস্তাবের ঘোরতর বিরোধী৷ কারণ, বিজেপির মতে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলা নামকরণ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর খামখেয়ালিপনা ছাড়া আর কিছু নয়৷ ঠিক যেভাবে একদা রেলমন্ত্রী থাকার সময় কলকাতার মেট্রো রেলের সম্প্রসারিত অংশের সব স্টেশনের ইচ্ছেমতো নামকরণ করেছিলেন তিনি৷ সেই নামের সঙ্গে স্টেশনের এলাকার দূরতম কোনও সংযোগ না থাকা সত্ত্বেও৷ এখনও মেট্রো রেলের যে নতুন অংশের কাজ চলছে, সেই দীর্ঘ যাত্রাপথের বিভিন্ন স্টেশনের নামও আগাম করে রেখেছেন তিনি৷ অবশ্য বাম আমলে যে অসুবিধার কথা উঠেছিল, অর্থাৎ ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল’ নামের জন্য বিভিন্ন প্রশাসনিক বৈঠকে সবার শেষে ডাক পাওয়া, সেই অসুবিধের কথা এখন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও বলছেন৷
কিন্তু রাজ্যে বিজেপির আপত্তি, পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলা হলে, সেটা এই অঞ্চলের ইতিহাসকে মুছে ফেলার সামিল হবে৷ বিজেপির রাজ্য নেত্রী, বর্তমানে দলের মহিলা শাখার প্রধান লকেট চট্টোপাধ্যায় বলেন, এই নামবদল মুখ্যমন্ত্রীর খেয়ালখুশিতেই করার চেষ্টা হচ্ছে৷ শুধু পূর্ব বঙ্গ-পশ্চিম বঙ্গের ঐতিহাসিক গুরুত্বই এতে নষ্ট হচ্ছে না, সেসময় হিন্দু-প্রধান পশ্চিমবঙ্গকে আগলে রাখতে তখনকার ভারতীয় জনসংঘের নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তাকেও খাটো করার চেষ্টা আছে এর পেছনে৷
আর লকেট জানালেন, বাংলাদেশেও এই নিয়ে ক্ষোভ প্রচুর৷ তাদের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’৷ পড়শি দেশের লাগোয়া রাজ্যটির নাম যদি হঠাৎ পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলা হয়ে যায়, তা হলে বাংলাদেশের জাতীয় অস্তিত্ব ও পরিচয়কেও অসম্মান করা হবে৷
সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার অবশ্য এই নামবদল নিয়ে আলোচনা করাটাই সময় নষ্ট বলে মনে করেন৷ তিনি বরং গুরুত্বই দিতে চান না একে৷ প্রশ্ন করলেন, কোথায় থাকো জানতে চাইলে লোকে স্থানীয় অঞ্চলের নামই বলে, রাজ্য বা দেশের নাম নয়৷ কাজেই সেটাই চলবে৷ আর লেখালেখির সূত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘদিন গভীরভাবে সম্পর্কিত সমরেশবাবু জানাচ্ছেন, এ নিয়ে যখন তাঁর বাংলাদেশি বন্ধুদের সঙ্গে কথা হয়, তারা রসিকতা করে৷ ঠাট্টা করে কেউ বলেন, তা হলে এবার আপনারা আমাদেরকেই অনুসরণ করছেন! কেউ আবার বলেন, ব্যাঙাচির লেজ খসে যেমন ব্যাঙ হয়, তেমন পশ্চিমবঙ্গ থেকে পশ্চিম খসে গিয়ে আপনারা বঙ্গ হবেন৷ প্রবীণ সাহিত্যিক বিশ্বাস করেন, রাজ্যের নাম বদলে গেলে যেমন এখানকার মানুষজনের জীবনে, যাপনে কোনো ফারাক হবে না, তেমনই বাংলাদেশের মানুষদেরও কিছু যাবে আসবে না৷ সুতরাং এই তর্ক নিরর্থক৷
বিজেপির মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য জানান, বিজেপি দল হিসেবে রাজ্যের নামবদলের বিরুদ্ধে। কারণ, নামবদল হলে একটা ইতিহাস বিলুপ্ত হয়ে যাবে বলে তারা মনে করেন। মানুষ মোদির ওপরই আস্থা রাখবেন।
বঙ্গ বা বাংলা নামের সঠিক উৎসটি অজ্ঞাত। এই নামের উৎস সম্পর্কে একাধিক মতবাদ প্রচলিত। একটি মতে এটি খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দে এই অঞ্চলে বসবাসকারী বং অথবা বাং নামক একটি দ্রাবিড় উপজাতির ভাষা থেকে এসেছে। সংস্কৃত সাহিত্যে বঙ্গ নামটি অনেক জায়গাতেই পাওয়া যায়। কিন্তু এই অঞ্চলের প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানা যায় না।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারতের বাংলা প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চল স্বাধীন ভারতের অঙ্গরাজ্যে পরিণত হলে এই রাজ্যের নামকরণ পশ্চিমবঙ্গ করা হয়েছিল। ইংরেজিতে অবশ্য West Bengal (ওয়েস্ট বেঙ্গল) নামটিই সরকারিভাবে প্রচলিত। ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার রাজ্যের ইংরেজি নামটি পালটে Paschimbanga রাখার প্রস্তাব দেয়।
পূর্ববঙ্গ নামটি ঐতিহাসিকভাবে বঙ্গ অঞ্চলের পূর্ব অংশকে বুঝিয়ে থাকে। ১৯০৫ থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ভারতের বঙ্গ প্রদেশের পূর্বাংশ পূর্ববঙ্গ নামে পরিচিত ছিল।পূর্ব বাংলা বলতে সেই সময় যে এলাকাকে বুঝানো হত তা বর্তমানে বাংলাদেশ নামে পরিচিত। তবে ব্রিটিশ আমলের পূর্ব বাংলার সীমানা বর্তমান বাংলাদেশের থেকে অনেকই বড় ছিল। মূলত অবিভক্ত বাংলার একটি নির্দিষ্ট অংশ এই নামে পরিচিত ছিল। ১৯১১ সালে বঙ্গপ্রদেশ পুনরায় যুক্ত হলে পূর্ববঙ্গ প্রদেশটি বিলুপ্ত হয়ে যায়। পরবর্তীতে ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তানের সৃষ্টি হলে এই অঞ্চলটি পুনর্নির্ধারণ হয়ে আগের তুলনায় একটু সংকুচিত হয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রূপ নেয়। আবার এই পূর্ব পাকিস্তান ১৯৭১ সালে স্বাধীন হলে এই অঞ্চলটি বর্তমান বাংলাদেশের সীমানায় রূপ নেয়।