সাগরপথে অবৈধ ভাবে ইউরোপ প্রবেশের তালিকায় শীর্ষে বাংলাদেশ
২০২১ সালের প্রথম ছয় মাসেই অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশ করেছেন ৪৭ হাজার ৪২৫ অভিবাসন প্রত্যাশী। শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ভূমধ্যসাগরপাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশের তালিকায় শীর্ষে আছে বাংলাদেশ। ঝুঁকি নিয়ে সাগরপাড়ি দিতে গিয়ে মৃত্যুর তালিকাতেও রয়েছে বাংলাদেশের নাম। জাতিসংঘ জানিয়েছে, চলতি বছরে এক হাজার অভিবাসন প্রত্যাশী ভূমধ্যসাগরে ডুবে মারা গেছেন। করোনাকালেও থেমে নেই সাগরপথে অবৈধভাবে ইউরোপ প্রবেশ । কেন ইউরোপ প্রবেশে এই মানুষের ঢল; বিপজ্জনক ভূমধ্যসাগরীয় পথে আগের চেয়ে মৃত্যুর হারও বেড়েছে৷ তবুও কেন থামছে না এই পথে ইউরোপে প্রবেশ করতে বাংলাদেশিদের আগ্রহ?মানবপাচার বিরোধী সংঘটকদের কাছে এটা এখন বড় প্রশ্ন । আন্তর্জাতিক অভিবাসনবিষয়ক সংস্থা আইওএম বলছে, করোনাকালেও অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সংখ্যা যেভাবে বেড়েছে, এর সমাধান বের না করা গেলে আগামীতে পরিস্থিতি হবে আরও ভয়াবহ।
ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে লিবিয়া ও তিউনিসিয়ার কয়েকটি রুট সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। মানবপাচারের কেন্দ্র বলা হয় লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলিকে। যা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন আইওএম কর্মকর্তারা।
২২ জুলাই ২০২১ প্রাণ যায় ১৭ অভিবাসনপ্রত্যাশী বাংলাদেশির। নৌকায় করে অবৈধভাবে ইউরোপে যাওয়ার পথে সাগরে ডুবে মারা যান তারা। এর আগে গত ২৪ জুন ২৬৭ জনকে উদ্ধার করে তিউনিসিয়ার কোস্টগার্ড। যাদের ২৬৪ জনই ছিলেন বাংলাদেশি।
চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত ইউরোপে অবৈধ পথে প্রবেশ করেছেন ৪৭ হাজার ৪২৫ অভিবাসনপ্রত্যাশী। এর মধ্যে ৪৪ হাজার ৯৩জন এসেছেন ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে৷ জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচএসিআরের তথ্য অনুযায়ী, মোট অভিবাসনপ্রত্যাশীর ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ, অর্থাৎ তিন হাজার ৩৩২জন বাংলাদেশি। এরপর রয়েছে যথাক্রমে টিউনিশিয়া (১২.৯ %), সিরিয়া (৭.৬%) ও আইভরি কোস্ট, মিশর, ইরিট্রিয়া, সুদান, আফগানিস্তানের মতো দেশ।
আইওএম-এর ডিসপ্লেসমেন্ট ট্র্যাকিং ম্যাট্রিক্স বা ডিটিএম-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে চার হাজার ৫১০ বাংলাদেশি জল ও স্থলপথে অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশ করে। চলতি বছরের প্রথমার্ধ্বেই এই সংখ্যার কাছাকাছি চলে এসেছে ইউরোপে অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সংখ্যা।
“ইউরোপে অবৈধভাবে যাওয়া মানুষের তালিকায় যে দেশগুলির নাম আছে, তা দেখলে আপনি বুঝতে পারবেন যে বাংলাদেশ ছাড়া বাকি দেশগুলিতে হয় দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ বা চরম দারিদ্র্যের মতো সমস্যা রয়েছে। বাংলাদেশে কিন্তু তেমন সংকট আছে বলে আমরা মনে করি না। তাছাড়া বেশিরভাগ বাংলাদেশি ইউরোপে অবৈধভাবে যেতে দালালদের কয়েক লাখ টাকা দিচ্ছেন, অথচ সেই টাকা দিয়ে দেশেই কোনো একটা ব্যবসা করা সম্ভব হতে পারতো। ফলে, এখানে বুঝতে হবে যে টানটা এগুলোর জন্য নয়। বাস্তবিক চাপের চেয়েও বেশি কাজ করে এখানে মানসিক, সামাজিক চাপের বিষয়টি। আর ইউরোপে যাওয়া অনেকের কাছে স্বপ্নের মতো, আর সেই স্বপ্নের সামনে বিপদ বা বাস্তবের যুক্তি দাঁড়ায় না।”
ফ্রন্টেক্সের দেওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে হাসান জানান যে, ২০০৯ সাল থেকে ইউরোপে অবৈধভাবে প্রবেশের মোট নয়টি পথ দিয়ে মোট ৬২ হাজার ৫৮৩জন বাংলাদেশি সেখানে ঢুকেছেন। এই সংখ্যার একটা অংশ ইউরোপে প্রবেশ করতে পারলেও সাগরপথের বিপজ্জনক পরিস্থিতিসহ অন্যান্য প্রতিকূলতার কারণে প্রাণ হারাতে হয়েছে বহু বাংলাদেশিকে।
হাসান জানান, এবিষয়ে নির্দিষ্ট সংখ্যা হলফ করে বলা যায় না৷ কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাগরে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের শনাক্ত করা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু ২০১৪ সাল থেকে যে তথ্য দেখা যাচ্ছে, তার ভিত্তিতে গড়ে প্রতি বছর শ’পাঁচেক বাংলাদেশি এই পথে প্রবেশ করতে গিয়ে মারা যান বলে ধারনা করেন বিশেষজ্ঞরা, জানালেন শরিফুল হাসান।
ইউরোপের যে স্বপ্নকে ধাওয়া করে দেশ ছাড়েন বাংলাদেশিরা, সেই স্বপ্ন তৈরি করতে একটা বড় ভূমিকা পালন করে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের পরিবারের সদস্যরা, জানান তিনি। হাসান বলেন, “আমরা যদি শরিয়তপুরের একটা গ্রামের উদাহরণ দেখি, যে গ্রামের নামই হয়ে গেছে ‘ইটালি পাড়া’, তাহলে আমরা বুঝতে পারব ঠিক কতটা সামাজিক চাপ থাকে এই অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ওপর। যে আত্মীয়-স্বজনরা সফলভাবে ইটালি বা ইউরোপের অন্য কোনো দেশে থেকে জীবনযাপন করেন, তারা অনেক সময় অভিবাসনপ্রত্যাশীদের বলেন যে কোনো মতে ইউরোপে চলে আসতে। ফলে, অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মনে একটা ধারণা সৃষ্টি হয় যে, যেকোনো উপায়ে ইউরোপে ঢুকতে পারলেই তার সকল সমস্যার অবসান হবে৷ ”
বাংলাদেশের তিনটি অঞ্চলকে ইউরোপগামী অভিবাসন-প্রবণ বলে চিহ্নিত করেছে ব্র্যাক, জানান শরিফুল হাসান। সিলেট বেল্ট, যার মধ্যে রয়েছে সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার। তারপর রয়েছে ফরিদপুর বেল্ট, যেখানে রয়েছে ফরিদপুর, মাদারীপুর ও শরিয়তপুর এবং সবশেষে রয়েছে মধ্য ঢাকার বেল্ট যার মধ্যে রয়েছে কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ ইত্যাদি অঞ্চল। মূলত এই তিনটি অঞ্চল থেকেই ইউরোপগামী বাংলাদেশিদের ঢল এসে থাকে।
ইউরোপের স্বপ্নালু জীবনের টান, পারিপার্শ্বিক সমাজের চাপ ও সাফল্যের প্রত্যাশাই বাংলাদেশিদের ঠেলে দিচ্ছে অবৈধ পথে ইউরোপে পাড়ি দিতে। এর মধ্যে অনেকেই দেশে ফিরে আসতে চান না লোকলজ্জার ভয়ে বা টাকা লোকসানের হিসাব করে। বহু বাংলাদেশিদের ইউরোপ থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হলে তাদের নতুন করে জীবন শুরু করতে সহযোগিতা করে থাকে ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম)বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।
বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে যাবার মোট ১৮টি রুট রয়েছে ও সবচেয়ে বেশি ইউরোপের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিচ্ছেন ৩১ থেকে ৩৫ বছর বয়েসি বাংলাদেশিরা। কিন্তু অবৈধ উপায়ে ইউরোপে প্রবেশ করার যে নানাবিধ বিপদ ও ঝুঁকি, সে বিষয়ে এখনও পুরোপুরি অবগত নন বাংলাদেশের জনগণ, জানাচ্ছেন হাসান। ফলে, ঠেকানো যাচ্ছেনা ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপগামী জনতার স্রোত।
ইনফোমাইগ্র্যান্টসের