হঠাৎ অভিযানের কারণ কী ?

0
304

হঠাৎ অভিযানের কারণ কী?

সম্প্রতি বাংলাদেশে বিনোদন জগতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মডেল, অভিনেত্রী, প্রযোজকসহ বেশ কয়েকজনের বাসায় সাম্প্রতিক সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালিয়েছে ৷ আলোচিত চিত্রনায়িকা পরীমণিকে বুধবার (৪ আগস্ট) রাতে আটক করে সদরদফতরে নিয়ে যায় র‍্যাব।পরীমনিসহ চারজনের বিরুদ্ধে বনানী থানায় মাদক আইনে দুইটি এবং পর্নগ্রাফি আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়৷ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাড়ি থেকে মাদক উদ্ধার, বাসায় পার্টি করাসহ বেশ কিছু অভিযোগ তুলে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে৷ তার মধ্যে গত জুনে এক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলা করা আলোচিত চিত্রনায়িকা পরীমনিও রয়েছেন৷ কয়েকদিনের এসব অভিযান, পুলিশের সরবরাহ করা তথ্য ও বক্তব্য মূল ধারার গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিস্তর আলোচনার জন্ম দিয়েছে৷অভিযানের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী ও বিশেষজ্ঞদের৷

হঠাৎ বিনোদন জগত সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এমন তৎপরতা অনেকে মনে করছেন,  প্রভাবশালীদের পৃষ্ঠপোষকতায় সাধারনত এরা এসব করে, তাদের কোন পক্ষের মধ্যে বিরোধের কারনে এই অভিযান হতে পারে৷ তবে এই অভিযান যে আইন শৃঙ্খলা রক্ষার তালিকাভুক্ত অভিযান তানিয়ে অনেকের প্রচণ্ড সন্দেহ আছে৷

বাংলাদেশ মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী এলিনা খান বলেন, ‘‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যদি সত্যি সত্যি সদিচ্ছা থাকে মদ-মাদকমুক্ত একটা সমাজ তৈরি করবে তাহলে রাঘববোয়ালদের ধরা হচ্ছে না কেন? এখানে তো কোন নিম্নবিত্ত না, মধ্যবিত্তও যাওয়ার সুযোগ পায় না৷ কারা সেখানে যায়, যাদের অবৈধ অঢেল টাকা আছে৷ দুর্নীতি করে যারা টাকা কামিয়েছে বা এই ধরনের খারাপ কাজের সঙ্গে যাদের সম্পর্ক আছে৷ যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের কাছ থেকে নামগুলো তো পাওয়া গেছে, কারা তাদের কাছে যায়৷ তাহলে তাদের কেন ধরে আনা হচ্ছে না?’’

মডেল, অভিনেত্রীদের গ্রেফতারের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের নামের আগে-পরে বিভিন্ন উপাধি বা বিশেষণ জুড়ে দিয়ে বক্তব্য দিচ্ছে৷ তাদেরকে ‘রাতের রানি’ হিসেবে উল্লেখ করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশিদ বক্তব্য দিয়েছেন বলে গণমাধ্যমের খবরে উঠে এসেছে ৷ আইন বিশেষজ্ঞ, মানবাধিকারকর্মী ও পুলিশের সাবেক-বর্তমান কর্মকর্তাদের অনেকেই এর সমালোচনা করছেন৷  পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা বলেন, ‘‘কাউকে গ্রেফতারের পর নামের আগে-পরে কোন পদবি বা উপাধি ব্যবহার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী করতে পারে না৷ পাশাপাশি সম্প্রতি যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে এবং যেভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে তাতে শেষ পর্যন্ত বিচারে তারাই সুবিধা পাবে৷ এই ধরনের মিডিয়া ট্রায়াল সব সময় আসামীদের পক্ষে যায়৷’’

মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, ‘‘সম্প্রতি যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের যে নানা বিশেষণে বিশেষায়িত করা হচ্ছে এটা একেবারেই অনৈতিক৷’’ তার মতে, ‘‘এই নারীদের গ্রেফতারের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যতটা উৎসাহ আমরা লক্ষ্য করছি, তার চেয়ে সামান্যতম উৎসাহও আমরা দেখছি না, এদের যারা এখানে এনেছে তাদের ধরার ব্যাপারে৷ বা এদের সঙ্গে যাদের মাদকের সম্পৃক্ততা রয়েছে তাদের আটকে কোন তৎপরতা আমরা দেখছি না৷ ফলে এই ধরনের অভিযানের উদ্দেশ্য নিয়ে জনমনে নানা ধরনের প্রশ্ন আছে৷ এই অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত নৈতিক অবস্থান ঠিক রেখে অভিযানগুলো পরিচালনা করা৷’’

অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘‘তারা যদি কোন সুনির্দিষ্ট অপরাধ করে থাকে, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকে পুলিশ তাদের গ্রেফতার করতে পারে, সুনির্দিষ্ট অভিযোগটা মিডিয়াকে জানাতে পারে৷ রাতের রানি হিসেবে অভিহিত করা এবং স্টেটমেন্ট আকারে বলা ওরা এই এই করেছে৷ অভিযোগ আকারে না, রায়ের মতো করে বলে দেওয়া হচ্ছে৷ এটা পুলিশ, পত্রিকা বা সামাজিক গণমাধ্যম কেউ করতে পারে না৷ পুলিশ বলছে, রাতের রানি৷ তাহলে তো রাতের রাজাও থাকবে৷ রাজারা কোথায়, তারা গ্রেফতার হচ্ছে না কেন? আর পুলিশ যে বলছে, ব্লাকমেইলিংয়ের অভিযোগ আছে৷ তো অভিযোগটা কে দিয়েছে? এটা তো আমরা জানতে চাই? মুখের কথায় অভিযোগ শুনে পুলিশ গ্রেফতার করতে যাবে, দেশ তো এখন ওই জায়গায় নেই৷ লিখিত অভিযোগ কেউ দিয়েছে? দিয়ে থাকলে পুলিশকে  সেটা জানাতে হবে৷ মদ বা মাদক যদি কারো বাসায় পাওয়া যায়, এই মদ তো হেঁটে হেঁটে তার বাসায় আসেনি৷ এটা নিশ্চয় কোথাও থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে৷ তাহলে মদ বিতরণ কেন্দ্র বা সংগ্রহ কেন্দ্রের সঙ্গে কারা জড়িত কখনই সেটা জানা যায় না৷ পরীমনি বা পিয়াসার ঘটনায় যারা পৃষ্ঠপোষক, বেনিফিশিয়ারি, যারা রাতের রাজা তাদের পরিচয় আমরা জানতে পারব না৷’’

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মতে, পরীমণি সিনেমায় আসার আগে থেকেই তার বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ ছিল। পরীমণির প্রকাশ্য অপকর্ম তার অনেক ঘনিষ্ঠজনকে বিব্রত করেছে।

পরীমণির বিরুদ্ধে মাদক গ্রহণ, মাদক বহন, অন্যকে মাদক নেওয়ায় উদ্বুদ্ধ করা ও মাদক বিক্রির মতো অভিযোগ ছিল। তিনি প্রায়ই এই কাজগুলো প্রকাশ্যে করেছেন। তাকে দীর্ঘদিন ধরে নজরদারিতে রেখেছিল গোয়েন্দারা।

এছাড়াও পর্ণগ্রাফি ছড়ানো, ব্ল্যাকমেইলিং, হয়রানি ও অন্যের বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগের সুনির্দিষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতেই তাকে আটক করা হয়। এছাড়াও তার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তার বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণগুলো পাওয়া যায়। বিপুল সংখ্যক মাদক উদ্ধার করি।

পরীমণির বাসা থেকে নতুন মাদক এলএসডি, মদ ও আইস উদ্ধার করেছে র‌্যাব। অভিযানে অংশ নেওয়া এক র‌্যাব কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে জানান, অভিযানে প্রথম দিকে পরীমণি র‍্যাবকে সহযোগিতা করেননি। তার ঘর তল্লাশি করে ফ্ল্যাটের কেবিনেট থেকে বিদেশি মদ, লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইইথ্যালামাইড (এলএসডি) এবং আইস উদ্ধার করা হয়েছে।

পরে তার ড্রয়িং রুমের কাভার, শো-কেস, ডাইনিং রুম, বেডরুমের সাইড টেবিল এবং টয়লেট থেকে বিপুল সংখ্যক মদের বোতল উদ্ধার করা হয়।

অভিযানে অংশ নেওয়া একজন জানান, পরীমণির বাসায় এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে মদ নেই। তার কাছে দেশি-বিদেশি নামিদামি ব্র্যান্ডের মদ ছিল, যা বাংলাদেশে খুব কমই আমদানি হয়।

এর আগে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে বিকেল ৪টার দিকে পরীমণির বাসায় অভিযানে যায় র‌্যাব-১ এর সদস্যরা। এসময় তাৎক্ষণিক ফেসবুক লাইভে এসে পরীমণি বিষয়টি সবাইকে জানায়। তিনি বলেন, অজ্ঞাতপরিচয় বিভিন্ন পোশাকের কয়েকজন ব্যক্তি বাসার বাইরে থেকে কলিং বেল দিয়ে দরজা খুলতে বলছে।আমি ভয় পাচ্ছি।

তিনি থানা-পুলিশ, ডিবির কর্মকর্তা ও তার পরিচিতজনদের কাছে ফোন করে তাকে বাঁচানোর আহ্বান জানান। বাইরে থেকে বারবার র‍্যাব তাদের পরিচয় দিলে ভেতর থেকে দরজা খুলছিলেন না তিনি। পরে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম এবং আইনশৃঙ্ক্ষলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বাসার বারান্দা দিয়ে দেখে বিকেল ৪ টা ৩৫ মিনিটে ভেতর থেকে দরজা খুলে দেওয়া হয়। এরপর র‍্যাব সদস্যরা ভেতরে ঢোকেন এবং শুরু করে তল্লাশি।

বিকেল সাড়ে চারটার দিকে বনানীর লেক ভিউ ১৯/এ নম্বর রোডের ১২ নম্বর বাড়িতে র‍্যাবের অভিযানের বিষয়টি ঢাকা পোস্টকে নিশ্চিত করেন এলিট ফোর্সটির লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক খন্দকার আল মঈন।

তিনি বলেন, সুনির্দিষ্ট কয়েকটি অভিযোগের ভিত্তিতে চিত্রনায়িকা পরীমণির বাসায় র‍্যাব অভিযান পরিচালনা করছে। অভিযান শেষে এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানানো হবে।

অভিযান চলাকালে পরীমণির বাসার নিচে দেখা যায়, র‍্যাব-১ এর একটি গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। এছাড়া, পুলিশের বেশ কয়েকটি গাড়িও ছিল। বাসার আশপাশে পুলিশ সদস্যরা অবস্থান করছেন। মূল গেটের সামনে কয়েকজন র‍্যাব সদস্যকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। অভিযান শুরুর ৩০ মিনিট পর তার বাসায় একে একে তিন থেকে চারজন র‍্যাবের নারী সদস্য প্রবেশ করেন। এরপর পরীমণিকে আটকের গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে।

গত ৯ জুন সাভারের বিরুলিয়ায় ঢাকা বোট ক্লাবে পরীমণিকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টা করা হয় বলে অভিযোগ করেন তিনি নিজেই। পরে ১৪ জুন সাভার মডেল থানায় নাসির উদ্দিন মাহমুদ ও অমিসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন তিনি।