সভ্য সমাজে অসভ্য প্রথা: নির্মূলে কোনো উদ্যোগ নেই
পতিতা বা পতিতালয় শব্দটি শুনলেই কেউ শিউরে উঠে, কেউ ভয়ে, লজ্জায়, ঘৃণায় এ প্রসঙ্গে কথা বলতে চায় না। আবার কেউ কেউ মনে মনে উৎসাহ সঞ্চার করে বা উত্তেজনা অনুভব করে। সমাজে সবচেয়ে নিগৃহীত মানুষদের মধ্যে পতিতারা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বব্যাপী এই পেশা এবং সংশ্লিষ্টদের করণীয় সম্পর্কে তর্ক-বিতর্ক বিদ্যমান। কেউ এই পেশাকে টিকিয়ে রাখার পক্ষে। কেউ চান চিরতরে বন্ধ করে দিতে। সভ্য সমাজের সভ্য পুরুষরাই যায় তাদের কাছে। অথচ সভ্যতা পতিতাদের ঘৃণা করে। অস্বীকার করে! এ অন্যায় মুখোশের আড়ালের ভিন্ন আচরণ।
কোন নারীই স্বপ্রণোদিত হয়ে এই পেশায় আসে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পেশাজীবী হিসেবেও জীবনের লক্ষ্য হয় না। কেউই স্বপ্ন নিয়ে পতিতা হয় না তবে স্বপ্ন উড়াতে পতিতালয়ে আসে। সাধারণত বাধ্য হয়ে, প্রতারণা ও নির্যাতনের শিকার হয়ে, প্রলোভনে, কিংবা অর্থের কারণে ভাগ্যের সন্ধানে পতিতাবৃত্তি শুরু করে। পথভ্রষ্ট হয়ে ছিটকে এসে পড়ে এই অন্ধগলিতে। সমাজ বা দেশের প্রচলিত ব্যবস্থা বাধ্য করে এ পথ বেছে নিতে। এই পেশায় আসার অন্যতম প্রধান কারণ সে বাঁচতে চায়। কিন্তু সে আশ্রয়হীনতায় ভোগে। আশ্রয়হীনরাই দালালদের পাতা ফাঁদে পড়ে। আর তার আশ্রয় হয় অন্ধকার গলি পতিতাপ্রথা টিকিয়ে রাখার জন্য নানা মহল উদগ্রীব, এতে কিছু নারী সংগঠন যেমন আছে, স্বয়ং পতিতারাও আছে। ক্রীতদাসপ্রথার সঙ্গে পতিতাপ্রথার তেমন পার্থক্য নেই। ক্রীতদাসরা যখন চাষের কাজ করতো, দাস মালিকরা প্রায়ই সশরীরে উপস্থিত হয়ে কিছু ক্রীতদাসীকে যৌনকর্মের জন্য তুলে নিয়ে যেতো এবং যৌন ব্যবসার জন্য ভাড়া খাটাতো, নয়তো সরাসরি পতিতালয়েই তাদের নগদ টাকায় বিক্রি করে দিতো। আগে যাকে বলা হতো ক্রীতদাসপ্রথা, এই শতকে বলা হচ্ছে পতিতাপ্রথা।
ক্রীতদাসপ্রথা আজ বিশ্বে নিষিদ্ধ। কিন্তু পতিতাপ্রথা নির্মূল করার কোন উদ্যোগ চোখে না পড়লেও খুব ভাল অবস্থানে আছে। দেহ বিক্রি করা পৃথিবীর প্রাচীনতম কোন পেশা নয়। তবে প্রাচীনতম যৌন দাসিত্ব, যৌন নির্যাতন একটি প্রথা। আজ পতিতাপ্রথা পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম এবং সবচেয়ে দ্রæত গতিতে বেড়ে ওঠা একটি ব্যবসা । তাই হয়তো পতিতাপ্রথাকে আজও পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ নির্মূল করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না! পতিতা পেশা সমাজের ভোগ্য হয়েও সমাজ থেকে মুখ লুকাতে হয় পতিতাদেরকে। অথচ এই পেশায় শখেরও নয় বিলাসিতাও নয়? পেশা হিসেবে পতিতাকর্ম ভাল কি মন্দ? গ্রহণযোগ্য কিংবা অগ্রহণযোগ্য? স্বীকৃতিযোগ্য অথবা পরিত্যাজ্য? সব জল্পনা কল্পনা-তর্ক বিতর্কের ঊর্ধ্বে বিবেচ্য বিষয় কতটুকু স্বাস্থ্যকর? কতটুকু ক্ষতিকর? নিজের জন্য, পরিবার, পরিবেশ, সমাজ তথা রাষ্ট্রের জন্য?
কোনো যুগে, কোনো দেশেই মানুষ পতিতাবৃত্তি নিয়ে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেনি, আজও করে না। তবে বিশ্বের বহু দেশেই পতিতাবৃত্তি বৈধ এবং সেখানে যৌনকর্মীরা নিয়মিত আয়করও দেয়। পতিতাপ্রথাকে বৈধ করা মানে নারী নির্যাতনকে বৈধ করা। আর সেই সভ্যতার নাম বর্বরতা ছাড়া অন্য কিছু নয়।
পতিতাবৃত্তির অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম প্রথম কারণ : চলচ্চিত্র, সাহিত্য, ম্যাগাজিন এবং অবেদনময়ী বিজ্ঞাপন পুরুষদেরকে উত্তেজিত করে । অশ্লীল গল্প-উপন্যাস এবং ছায়াছবির ব্যাপক ছড়াছড়ির ফলে বিভিন্ন অপর্কমে পুরুষরা প্রভাবিত হয় । হাতের মুঠোয় ইন্টানেটে অশ্লীল সাইটে তরুণ প্রজন্মকে অপর্কমে উৎসাহিত করে। তখনই তারা যে কোনো উপায়ে নারী ধর্ষণের চেষ্টা করে, না পারলে পতিতালয়ের যাবার চেষ্টায় থাকে। প্রশ্ন উঠতে পারে, যখন চলচিত্র আবিষ্কার হয়নি তখনও তো পতিতালয় ছিল। তখন চলচিত্র না থাকলে অশ্লীল সাহিত্য, উত্তেজক পেইন্টিং ও চারুশিল্পের অস্তিত্ব ছিল। শত শত বছর আগের উলঙ্গ ভাস্কর্য, নগ্ন নারী চিত্র ও নারী-পুরুষের মিলনের বহু চিত্র আবিষ্কৃত হয়েছে।
দ্বিতীয় কারণ জৈবিক তাড়না প্রকৃতিগত। যৌবনের তাড়না স্বাভাবিকভাবেই প্রকৃতিগত। এ জন্যই বিয়ের ব্যবস্থা। কিন্তু যেকোনো কারণে হোক বিয়ে করতে দেরি হলে বয়সের দাবি তো তার অধিকার ছাড়বে না। তাই যৌবনের স্বাভাবিক তাড়নায় যুবকরা বাধ্য হয় অন্ধগলিতে যায়। যদিওবা তরুণরা বা স্ত্রী সঙ্গহীন পুরুষরাই অধিকহারে পতিতালয়ের প্রবেশ করে ।
তৃতীয়ত: যত কারণই থাক ধর্মহীনতা ও নৈতিকতার অবক্ষয় সকল অপকর্মের মূল কারণ। তা যেমন যৌন অপরাধের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, অন্যান্য ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। ধর্মের কথা বাদ দিলেও সভ্যতা ও মানবতার দৃষ্টিতে পতিতালয়ের প্রবেশ জঘন্যতম কাজ। সবচেয়ে নোংরা ও নৈতিকতাহীন কাজ এটি। মজার ব্যাপার হল, অনেকে আছেন, যারা পতিতাবৃত্তির বিরুদ্ধে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে বেড়ান আবার তারাই রাতের আঁধারে খদ্দের হয়ে ভেজা বেড়ালের মতো মাথা গুঁজে ঢোকেন নিষিদ্ধ পল্লীতে বা অন্য কোনখানে। সামগ্রিকভাবে এটা নৈতিকতার চরম অবক্ষয়।
পতিতালয় শব্দটা অশ্লীল মনে হলেও সভ্য সমাজে কল র্গাল, স্কট সার্ভিস বা বিভিন্ন ইংরেজি নামের শব্দ সম্মিলিত সার্ভিসের কথা বলে নারীদেরকে দিয়ে মনোরঞ্জনের জন্য যে সার্ভিস বা আসর সমাজে প্রচলিত তা কিন্তু পতিতাবৃত্তি হিসেবে আমরা দেখিনা। যত আলোচনা সমালোচনা শুধু পতিতালয় বা পতিতা পল্লী নিয়ে । কারণ এর সাথে জড়িতদের সামাজিক মর্যাদা আর অর্থনীতি সম্পৃক্ত।
বিবেকের কারণে হোক মানবতার কারণ হোক কিছু কিছু দেশ পতিতাবৃত্তিকে আইনি প্রক্রিয়া এনেছে। ইউরোপের সব দেশেই পতিতাবৃত্তি আইনত বৈধ। তবে আইন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেশভেদে ভিন্ন। যেমন স্পেন এবং পর্তুগালে দেহব্যবসা বৈধ। কিন্তু স্পেনে কাউকে জোর করে বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌনকর্মী বানানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
২০০০ সালের হাইকোর্টের এক রায় অনুযায়ী বাংলাদেশে পতিতা ব্যবসা আইনত বৈধ তবে তা নিয়ন্ত্রিত। পতিতা হিসেবে কাজ করতে হলে তাকে অনূর্ধ্ব ১৮ বৎসর হলে অবশ্যই নিবন্ধন হতে হবে এবং আদালতে উপস্থিত হয়ে একটি হলফনামা জমা দিতে হবে এই মর্মে যে,তারা তাদের নিজস্ব পছন্দ ও জোর-জবরদস্তি ছাড়াই পতিতাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে এবং তারা অন্য কোন পেশা খুঁজে পেতে অসমর্থ। অথচ দেশের সামাজিক বা ধর্মীয় ব্যবস্থা ছাড়াও বাংলাদেশের আইন ও সংবিধানের সাথে তা সাংঘর্ষিক। সংবিধানের ১৮(২) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘রাষ্ট্র জুয়া এবং যৌন ব্যবসার বিরুদ্ধে কার্যকরী সুরক্ষা প্রদান করিবে।’ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এ সুযোগটি ব্যবহার করেই যুগ যুগ ধরে যৌনপল্লী উচ্ছেদ, নানাভাবে যৌনকর্মীদের নির্যাতন ও হয়রানি করে আসছে। ২০১২ সালে দেশে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন হয়। এ আইনের ১২(১) ধারায় বলা আছে, কোনো ব্যক্তি পতিতালয় স্থাপন বা পরিচালনা করলে অথবা তা স্থাপন বা পরিচালনা করতে সক্রিয়ভাবে সহায়তা বা অংশগ্রহণ করলে তিনি অপরাধ করেছেন বলে গণ্য হবেন এবং উক্ত অপরাধের জন্য তিনি অনধিক ৫ (পাঁচ) বছর এবং ৩ (তিন) বছর সশ্রম কারান্ড ও ২০ (বিশ) হাজার টাকা অর্থদন্ডে দন্ডিত হবেন। এ আইনের ১৩ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি রাস্তায় বা জনসাধারণের ব্যবহার্য স্থানে অথবা গৃহ অভ্যন্তরে বা গৃহের বাইরে পতিতাবৃত্তির উদ্দেশ্যে মুখের ভাষায় বা অঙ্গভঙ্গি করে বা অশালীন ভাবভঙ্গি দেখিয়ে অন্য কোনো ব্যক্তিকে আহ্বান জানালে সে অপরাধ করেছে বলে গণ্য হবে। এ রকম অপরাধের জন্য সে অনধিক তিন বছর কারাদন্ডে অথবা সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা অর্থদন্ডে অথবা উভয় দন্ড দন্ডিত হবেন। আমাদের দন্ডবিধির ২৯০ ধারায় গণ-উপদ্রব নামের একটি আইন আছে। সেই আইনের অধীনে অনৈতিক কাজে লিপ্তদের শাস্তি সর্বোচ্চ ২০০ টাকা জরিমানা।
নারী আন্দোলনকারী মহিলা সংগঠনগুলো নারী অধিকার সংরক্ষণের ভূমিকায় কথা বলেন। অথচ মহিলা হয়ে এই সংস্থাগুলি এমন একটি অমানবিক জঘন্য পেশার বিরুদ্ধে কোন জোরালো পদক্ষেপ নেন না বা বক্তব্যও রাখে না। মহিলারাই যদি মহিলাদের অমর্যাদার প্রতিকার দাবি না করেন, সে বড় দুর্ভাগ্যের কথা। আমরা আশা করবো, মহিলা সংগঠনসমূহ এ ব্যাপারে দৃঢ়পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে আসবেন।
বাংলাদেশের আইনে পতিতালয়ের ভেতরে মেয়েদের ওপর যৌন নির্যাতন চললে কোন প্রতিকার দেখা যায় না। পতিতালয়ের সীমানার বাইরে ভদ্র পরিবেশকে কলুষিত করার দায়ে পতিতাদের লাঞ্ছিত করা হয়। পতিতারা কেন পতিতা তার কোন প্রতিকার নাই, যারা মূল অপরাধী, যারা নির্যাতনকারী, তাদের শাস্তি না দিয়ে মেয়েদের, নির্যাতিতদের দেওয়া হয় শাস্তি। বাংলাদেশে যদি শরীর ক্রয় করা নিষিদ্ধ হয়, তাহলে নারী নির্যাতনের ব্যবসা বা পতিতাবৃত্তি অনেকাংশে কমে যাবে।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, সাদার্ন ইউনিভার্সিটি ও টেকসই উন্নয়নকর্মী