ঢাকা–মস্কো সম্পর্কের ৫০ বছর
বাংলাদেশের সঙ্গে রাশিয়ার কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর । সুপার পাওয়ার তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন বা আজকের রাশিয়ান ফেডারেশন ১৯৭১ সালে ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যার নিন্দা জানিয়ে গণহত্যা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে অবস্থান নিয়েছিল।সেই সময়ে দ্বিমেরু বিশ্ব ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান-চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন।বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
পাকিস্তানের সাথে সরাসরি বন্ধুত্ব বা তিক্ততার সম্পর্ক ছিল না জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য পঞ্চশক্তির অন্যতম তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের। কিন্তু তারপরেও বাংলাদেশকে সমর্থনে বৃহৎ শক্তির দেশটির এগিয়ে আসার কারণ হিসেবে বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
সে সময় বিশ্বরাজনীতিতে যেমন চলছিল একধরনের অস্থির অবস্থা। পৃথিবী দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে, একদিকে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র দেশসমূহ।অন্যদিকে কম্যুনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন। উভয়ের লক্ষ্য নিজের প্রভাব বলয় সমৃদ্ধ করা। যারফলে যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে চলছে স্নায়ুযুদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধে একেবারে শেষদিকে, ডিসেম্বরের তিন তারিখে ভারত যখন মুক্তিযুদ্ধে যুক্ত হয়, সে সময় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব তোলে।তাতে চীনও সমর্থন দেয়, কিন্তু সে প্রস্তাব ভিটো দিয়ে ঠেকিয়ে দিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন।বিশ্লেষকেরা মনে করেন, যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব ওই সময় পাস হলে ১৬ই ডিসেম্বরে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারত না বাংলাদেশ। যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব পাস হলে যুদ্ধ আরো দীর্ঘ হতো।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের পর ১৯৭২ সালের ২৪শে জানুয়ারি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। পরেরদিন ২৫শে জানুয়ারি দুইদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনে সেসময় শুরুতেই দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রামকে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করার কাজে যুক্ত হয় দেশটি।
১৯৭২ সালে চট্টগ্রাম বন্দর এবং কর্ণফুলী নদী থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর পোঁতা মাইন এবং যুদ্ধের সময় ডুবে যাওয়া জাহাজ অপসারণ করতে সহযোগিতা করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। প্রায় এক বছর ধরে সোভিয়েত প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহরের ২২টি জাহাজ কাজটি করে ।এরপরে সেসময় অর্থনৈতিক, শিক্ষা এবং সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসে সোভিয়েত ইউনিয়ন।
সম্পর্ক গভীর করার প্রচেষ্টা হিসেবে দুইদেশের মানুষে মানুষে সম্পর্কের দিকে জোর দেয়া হয়।প্রচুর মানুষ সেসময় রাশিয়া পড়তে গেছেন বাংলাদেশ থেকে।কম্যুনিস্ট আদর্শ জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যে সেসময় বাংলাদেশের শিল্প সংস্কৃতি এবং প্রকাশনা ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রচুর বিনিয়োগ করে।
১৯৭৫ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পরের কয়েক বছর একের পর এক সামরিক অভ্যুত্থান এবং ক্ষমতার পালাবদলে বাংলাদেশের রাজনীতি হয়ে ওঠে দুর্যোগপূর্ণ।দেশের পররাষ্ট্রনীতি তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের বদলে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রমুখী হয়ে ওঠে।বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে অবনতি ঘটে।পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন ছাড়াও দেশের ভেতরকার রাজনৈতিক পরিস্থিতিও আরেকটি কারণ হিসেবে দেখা দেয়।
আশির দশকের শুরুতে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো জোটবদ্ধ হয়ে আন্দোলন শুরু করে। ১৯৮৩ সালের শেষদিকে ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের’ অভিযোগে নয়জন রুশ কূটনীতিকে বহিষ্কার করে বাংলাদেশ। সম্পর্কে চূড়ান্ত অবনতি ঘটে তখন। এর মধ্যে আফগানিস্তানে সোভিয়েত হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে বাংলাদেশসহ আরো ৬৪টি রাষ্ট্র ১৯৮০ সালে মস্কোতে অনুষ্ঠিত গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক গেমস বয়কট করে, সোভিয়েত ইউনিয়ন বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায়, আত্মপ্রকাশ করে রাশিয়ান ফেডারেশন। বাংলাদেশ তখন রাশিয়ান ফেডারেশনকে স্বীকৃতি দেয়।ওই সময় থেকে সম্পর্ক কিছুটা ভালো হতে শুরু করে।সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর বিশ্ব-রাজনীতির ধরণে কিছুটা পরিবর্তন দেখা যায়।সেসময় দেখা যায়, বৃহৎ শক্তিধর দেশগুলো রাজনৈতিক প্রভাব বলয় তৈরি ও বজায় রাখার জন্য যুদ্ধ বা সংঘাতের পথে না হেটে অর্থনৈতিক প্রভাব তৈরির মাধ্যমে কাজটি করতে শুরু করে।”ওই একই সময়ে এশিয়ার দেশগুলো অর্থনৈতিক স্বার্থের বিচারে নিজেদের মধ্যে এক ধরণের আঞ্চলিক ঐক্য গড়ে তুলতে শুরু করে।এর ফলে বৃহৎ শক্তির দেশগুলো সবাই নতুন করে এশিয়ার দিকে মনোযোগ দেয়।””এর ফলে নতুন করে সম্পর্কের বিকাশ হয়, এবার অর্থনৈতিক সহযোগিতা, বিনিয়োগ এবং অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্ক উন্নয়ন করে,” ।
রাশিয়ার সাথে বাংলাদেশের এখনকার সম্পর্কের মূল ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে অর্থনৈতিক সম্পর্কের ওপর।রাশিয়া বাংলাদেশকে মূলত তিনটি দিকে সহযোগিতা করে যাচ্ছে, যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করছে।”দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কে মূলত তিনটি ভিত্তি এখন, প্রথমটি ভৌত অবকাঠামো খাত। এর মধ্যে পড়বে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সাহায্য। দ্বিতীয়ত মানবসম্পদ উন্নয়নে কারিগরি সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করা।”
পাবনার রূপপুরে নির্মিত হচ্ছে দেশের একমাত্র পারমানবিক বিদ্যুতকেন্দ্র, যার নির্মাণে বড় অংশের অর্থটি এসেছে রাশিয়ার দেয়া ঋণ থেকে এবং এটি নির্মাণ করছে রুশ রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান, রোসাটম।২০২৪ সালে নির্মাণ শেষে সেখান থেকে উৎপাদিত হবে ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।
ইতিমধ্যে ঘোড়াশালে সাড়ে চারশো মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ-কেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছে রাশিয়া। এদিকে বাংলাদেশের সাথে রাশিয়ার সম্পর্ক পাঁচ দশকের হলেও এখনো দুই দেশের আমদানি রপ্তানি অনেক বেশি নয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ রাশিয়ায় প্রায় ৪৯ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। একই বছর রাশিয়া থেকে ৭৯ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। এই মূহুর্তে বাংলাদেশের ৭৬টি পণ্য রাশিয়ার বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধায় প্রবেশ করছে।তবে এর মধ্যে নেই বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক।
এক্ষেত্রে তৈরি পোশাকের শুল্কমুক্ত বাজার, ওষুধ, এবং চামড়া রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টির চেষ্টা করতে হবে। সেই সঙ্গে রাশিয়ার শ্রমবাজারে বাংলাদেশি শ্রমিক পাঠানোর সম্ভাবনা কাজে লাগানো উচিত ।বাংলাদেশ এখন কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, ওষুধ, সিরামিকজাতীয় পণ্য এবং চামড়া শিল্পে শুল্কমুক্ত সুবিধা চাইছে রাশিয়ার কাছে। সেই সাথে রাশিয়া বাংলাদেশ থেকে মাছ, সবজি, আলু আমদানিতে আগ্রহ দেখিয়েছিল।দেশটির বাজারে বাংলাদেশের নিটওয়্যার, ওষুধ, চিংড়ি, চামড়াজাত পণ্যেরও বিপুল চাহিদা রয়েছে।