উপাচার্য : উৎকর্ষ ও উন্নয়নের প্রতীক

0
260

উপাচার্য : উৎকর্ষ ও উন্নয়নের প্রতীক

কে হচ্ছেন নতুন উপাচার্য? এ নিয়ে যেন জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়ে এমন আলোচনা পত্রিকায় প্রায়ই দেখা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক আসনে কে বসতে যাচ্ছেন তা নিয়ে মেয়াদ শেষ হওয়ার অনেক আগে থেক্‌েই বেশ জল্পনা-কল্পনা দৌড়-ঝাঁপ শুরু হয়ে যায়। সবসময় এই পদটিতে আসীন হতে প্রতিযোগিতার দৌড়ে এগিয়ে থাকেন বিভিন্নভাবে ক্ষমতাসীন দলের ক্ষমতাবান শিক্ষকগণ। পদপ্রত্যাশী শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে পরবর্তী চার বছরের নিয়োগ পাওয়ার আশায় শুরু করেন তদবির। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও নীতিনির্ধারকদের কাছে এ পদের জন্য ব্যাপক লবিং ও রাজনৈতিক তদবির শুরু করেন। নিয়ম অনুযায়ী উপাচার্য নিয়োগ দেওয়ার এখতিয়ার মহামান্য রাষ্ট্রপতির। তবে রাষ্ট্রপতি এককভাবে এই নিয়োগ দেন না। বিভিন্ন মাধ্যমে থেকে আসা নাম শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রস্তাব আকারে নথি তৈরি করে। যা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে যায়। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য পদে কে নিয়োগ পাচ্ছেন, তা অনেকাংশে নির্ভর করে সরকারের অভিপ্রায়ের ওপর।

বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা প্রদানের উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ মূলত তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা: সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় , বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়। কেন্দ্রীয়ভাবে সংযুক্ত এবং বিশেষ বিশ্ববিদ্যালয় সহ ৫৮ টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। স্বায়ত্তশাসিত হিসেবে পরিচালিত এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জনগণের করের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। সরকারি নিয়ন্ত্রণে বেসরকারি অর্থায়নে ১০৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এর বাইরেও দুটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। যা বিশেষ আইনের অধীনে প্রতিষ্ঠিত এবং আন্তর্জাতিক সংগঠন কর্তৃক পরিচালিত।

বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান বিতরণ ও চর্চার জায়গা। উপাচার্য পদটি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী প্রধানের পদ। তিনি শিক্ষার্থী, শিক্ষক, গবেষক, স্টাফ এবং সিনেটে/ট্রাস্টিতে থাকা জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিদেরকে নেতৃত্ব দিবেন, এটাই স্বাভাবিক । কিন্তু দেশের কয়জন উপাচার্য এই নেতৃত্বে আছেন! বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান কোথায় নেমেছে, তা সবাই জানে। জাতিসংঘের উন্নয়ন বিষয়ক সংস্থা ইউএনডিপির বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার সর্ব নিম্ন অবস্থানে বাংলাদেশ। আমরা চাই উপাচার্যরা তাদের দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু প্রশাসন চালানোর মতো যোগ্যতা দক্ষতার অভাবে এই মেধাবী শিক্ষকরা অনেক সময় সকলকে বিব্রত করেন। অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়ে থাকে যার নেতিবাচক প্রভাবে হীনম্মন্যতায় ভুগেন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষক এবং অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা।

উপাচাযর্’র নেতৃত্বে একটি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা, উদ্ভাবনসহ জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিচরণ করে। আর আমাদের উপাচার্যরা তার পরিবর্তে শিক্ষা জ্ঞান-বিজ্ঞান বহির্ভূত বক্তব্য দিয়ে বেড়ান । আমাদের কোন বিশ্ববিদ্যালয় এশিয়া বা আন্তর্জাতিক কোন সূচকে বা গবেষণা জ্ঞান-বিজ্ঞান উদ্ভাবনে দেখা যায় না। শুধু তাই নয় তার জন্য কোন বাস্তব সম্মত পরিকল্পনাও তাঁদের নাই। সংবাদপত্রে দেখা যায়, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যোগ্যতা অভিজ্ঞ তার ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয় না, এখানে ব্যক্তি বা বিশেষ বিবেচনায় এবং অনেক ক্ষেত্রে লেনদেনের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়।

সকলের প্রত্যাশা ঐতিহ্যবাহী এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যিনি দায়িত্ব পাবেন তাঁর হাত ধরে বিশ্ববিদ্যালয় অনন্য উচ্চতায় উঠবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎকর্ষ ও উন্নয়নে তিনি ভূমিকা রাখবেন। তিনি হবেন একজন স্বপ্নদ্রষ্টা। যিনি স্বপ্ন দেখাবেন; যাকে আদর্শ ধরে শিক্ষার্থীরা নিজেদের তৈরি করবে দেশ গড়ার এক একজন কারিগর। তাঁর আচরণ, দেশপ্রেম, সততা, কর্তব্য ও দায়িত্ববোধ এবং নৈতিক মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত হয়ে তিনি হতে পারেন সকলের শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব, গর্বের জায়গা। কিন্তু কেন জানি গত কয়েক দশক ধরে এ দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়ারা এধরনের উপাচার্য পান না।

গণমাধ্যমের কল্যাণে আর্থিক দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, নিয়ে সংবাদে যা দেখা যায় তাতে করে দেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং জ্ঞানীগুণী শিক্ষকদের সম্পর্কে আস্থা হারিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষকতার পেশা প্রশ্নবিদ্ধ। সফলভাবে পূর্ণ মেয়াদে উপাচার্যের দায়িত্ব শেষ করে নজির স্থাপন করেছেন এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে গত কয়েক দশকে পাওয়া মুশকিল। শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীর উপস্থিতিতে আবেগঘন পরিবেশে হাতে গুণা কয়েকজন উপাচার্য ক্যাম্পাস ত্যাগ করতে পেরেছেন।

সঠিক শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে যে কেউ উপাচার্য হতে পারেন। উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে যদি রাজনৈতিক পরিচয় বা স্বজনপ্রীতি প্রাধান্য না থাকে, শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ সুস্থ থাকবে। শিক্ষকদের বিবেধের প্রতিযোগিতা অনেকাংশে কম হতো। প্রশাসনে অনভিজ্ঞ ও কমযোগ্য শিক্ষক যদি উপাচার্য হন, তাঁরা কৃতার্থ হয়ে অনুগত থাকবেন কোন সন্দেহ নাই, যার ফলে তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব পালনে লোভী, বেপরোয়া অথবা শৈথিল্য দেখাবেন।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক ও প্রশাসনিক নেতৃত্ব দেন উপাচার্য। উপাচার্যকে হতে হয় একাডেমিক আইকন এবং প্রশাসনিকভাবে দক্ষ ও যোগ্য। কিন্তু এ দিকটিতে নজর না দিয়ে রাজনৈতিকভাবে তদবিরের ওপর ভিত্তি করে দলীয় উপাচার্য নিয়োগ দেওয়ায় অধিকাংশ উপাচার্য নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়কে একাডেমিকভাবে এগিয়ে নিতে পারেন না। প্রশাসনিক ও একাডেমিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে খুব কমসংখ্যক উপাচার্যই নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে পারেন।
সরকারি অনেক উপাচার্যের বিরুদ্ধেই দুর্নীতিতে জড়িত হওয়ার অভিযোগ আছে। আর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উপাচার্যের দুর্নীতি-অনিয়ম তদন্ত করার জন্য গঠিত হয়েছে তদন্ত কমিটি। এসব তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে দুর্নীতির সত্যতা প্রমাণিত হলেও তাঁদেরকে সম্মানের সাথেই অপসারণ করা হয়েছে। যার ফলে উপাচার্যদের দুর্নীতি কমে না। উপাচার্যদের দুর্নীতি বন্ধের একমাত্র উপায় সর্বপ্রথম উপাচার্য নিয়োগের সময় সতর্ক হওয়া। প্রকৃত শিক্ষাপ্রেমী, সৎ, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন প্রশাসনে অভিজ্ঞ ও যোগ্য ব্যক্তিদের তালিকা করে সেই তালিকা থেকে উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ দিলে পদটি কলংকিত হবেনা।

অনুগতদের স্বার্থে ভূমিকা পালন করতে গিয়ে অধিকাংশ উপাচার্য শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটিতে প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করতে পারেন না। এ অবস্থায় শিক্ষক-কর্মচারীদের নিয়োগের ক্ষেত্রে পেশাদারিত্ব না থাকায়, বিশ্ববিদ্যালয় তার মূল জায়গা থেকে অর্থাৎ জ্ঞান চর্চা, জ্ঞান বিতরণ এবং নতুন জ্ঞান সৃষ্টি থেকে অনেকটাই বিচ্যুত হয়ে পড়ে । অথচ শিক্ষার মান, গবেষণা কার্যক্রম প্রসারে এমনকি দুর্নীতি-নিপীড়ন প্রতিরোধে উপাচার্য অগ্রণী ভূমিকা রাখবেন এটাই সবার প্রত্যাশা। দুর্ভাগ্য উপাচার্যদের সঠিক জবাবদিহি না থাকায় কিছু কিছু উপাচার্য হয়ে ওঠেন স্বেচ্ছাচারী বা দুর্নীতিগ্রস্ত কোন কোন ক্ষেত্রে দুটোই। যা সমাজকে করে বিব্রত। বিশ্ববিদ্যলয়ের আসল কাজ শুধু সনদ বিতরণ নয়, মূল কাজ- জ্ঞান তৈরি করা, জ্ঞানদান, এবং তা কাজে লাগানো। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ থেকে তাঁরা অনেক দূরে। এখন ক্ষমতা ও অর্থলিপ্সার কারণে উপাচার্য পদের অপব্যবহার হয়। নিজের স্বার্থে শিক্ষক-কর্মকর্তা-শিক্ষার্থীদেরকে ব্যবহার করে অপকর্ম করেন। শিক্ষার চেয়ে ব্যবসা বাণিজ্যে লিপ্ত হন। প্রাক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, উচ্চ শিক্ষা, উন্নয়ন ও উদ্ভাবন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, অর্থনীতি আর পরিবেশ নিয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ নেন না এবং কথাও বলতে দেখা যায় না।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যলয়ের উপাচার্যরা যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন তাও নয়। তাঁদের অনেকেই বেসরকারি প্রাতিষ্ঠানিক ক্রিয়াকলাপের অভিজ্ঞতা না থাকার সাথে ট্রাস্টের দাপটে সাজানো ব্যক্তিত্ব নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। অনেক সময় সরকারি অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে গিয়ে নিজেকেই হারিয়ে ফেলেন। অনেকে ট্রাস্টকে প্রাধান্য দিতে চান না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যলয়ে ট্রাস্টই মূখ্য। ট্রাস্টের চিন্তা-চেতনা নির্দেশনায়ই বিশ্ববিদ্যলয় চলার কথা। অথচ সকলকে মানিয়ে সকল নিয়ম মেনে দেশের আর্থ সামাজিক অবস্থা মাথায় রেখে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যলয়কে চলতে হয় কর্পোরেট সংস্কৃতিতে। যদিও অনেক উপাচার্যরাই তা মানতে চান না। এটাই সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যলয়ে অন্যতম পার্থক্য।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হবেন তারা যারা গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়ে জ্ঞানে বিজ্ঞানে নতুন নতুন তত্ত্ব ও তথ্য আবিষ্কার করার সুযোগ সৃষ্টি করে সমাজকে বিকশিত করবেন। উপাচার্য হবেন এমন কেউ, যিনি হবেন ‘সর্বজনশ্রদ্ধেয় ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব’। তাদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ নৈতিক মান আশা যেমন করেন সবাই তেমনি সঠিক আচরণও। উপাচার্যরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎকর্ষ ও উন্নয়নের প্রতীক অথচ প্রধান নির্বাহীর দাপটে উপাচার্যরা একগুঁয়ে আচরণে এবং মূল্যবোধের অবক্ষয়ে সংক্রমিত।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, সাদার্ন ইউনিভার্সিটি ও টেকসই উন্নয়নকর্মী