রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ: বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রভাব

0
171

রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ: বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রভাব

দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে (কভিড-১৯ প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতি পর্যুদস্ত।  উৎপাদন ও বিপণন  ব্যবস্থা প্রায় অচল ছিল এ সময়ে। অগণিত  ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান  দেউলিয়া  হওয়ায়  বিরূপ প্রভাব পড়েছে অর্থনীতিতে। এ সংকট  কাটিয়ে  বিশ্ব  যখন মন্থরগতিতে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ সেই গতি আরো মন্থর করবে। এর তার নেতিবাচক অর্থনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত থাকার সুযোগ বাংলাদেশের কতটুকু৷ এই যুদ্ধ যত জোরদার ও দীর্ঘায়িত হবে, ততই বিপদের আশঙ্কা দেখছেন বিশেষজ্ঞরা৷

রাশিয়া থেকে বাংলাদেশে আমদানির ক্ষেত্রে শীর্ষে আছে সবজি ও তেল এই বিপদ দু’দিক থেকে আসবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা৷ একটি হলো বাণিজ্যের দিক থেকে ৷ আরেকটি হচ্ছে ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে, যা তাৎক্ষণিক নয়, বরং সুদূরপ্রসারী কিছু নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে৷রাশিয়ার সাথে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য তুলনামূলকভাবে অনেক কম৷ ইউক্রেনের সাথে আরো কম৷ ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে ৪৮ কোটি ডলারের পণ্য আমদানির বিপরীতে রপ্তানি করেছে ৬৬ কোটি ৫৩ লাখ ডলারের পণ্য৷ বাংলাদেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৯৫ শতাংশই হলো তৈরি পোশাক ও বস্ত্র সামগ্রী ৷ একই সময়ে ইউক্রেন থেকে ৫১ কোটি ৭০ লাখ ডলারের পণ্য আমদানির বিপরীতে দেশটিতে রপ্তানি করা হয়েছে ৩১ কোটি ৭৬ লাখ ডলারের পণ্য৷ আমদানির বেশিরভাই হলো সবজি৷পণ্য রপ্তানির বিপরীতে প্রাপ্য মূল্য পেতে আরো বেশি সমস্যা হতে পারে৷ আর নতুন করে রপ্তানির কার্যাদেশ কমে যাওয়ার শঙ্কাও রয়েছে৷ সব মিলিয়ে রাশিয়ায় ৬০ কোটি ডলারের বেশি বার্ষিক রপ্তানি ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে৷

তবে যুদ্ধের কারণে দুই দেশের সঙ্গে মোট ১৮০ কোটি ডলারের পণ্য বাণিজ্যের পুরোটাই ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে৷ এমনিতেই যুদ্ধকালীন সময় বাণিজ্যের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হয়, বাণিজ্য ব্যয়বহুল হয়৷ আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার সঙ্গে লেনদেনের ক্ষেত্রে যেসব নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তাতে করে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে৷

রাশিয়ার যেসব ব্যাংক এখনো সুইফট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়নি বা কোনো নিষেধাজ্ঞায় পড়েনি, সেসব ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন করা হলেও পশ্চিমা ব্যাংকগুলো বা করেসপনডেন্স ব্যাংকগুলো আগের চেয়ে অনেক বেশি সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিতে পারে যা লেনদেনকে কঠিন বা ব্যয়বহুল এমনকি অনিশ্চিত করে তুলতে পারে৷

অনেকে মনে করেন, ইউক্রেন সংকট থেকে প্রাথমিকভাবে আঘাতটা আসবে খাদ্যপণ্য, বিশেষত গম এবং জ্বালানি তেলে৷ বিশ্ববাজারে গমের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জোগান দেয় রাশিয়া ও ইউক্রেন৷ চলমান সংঘাতের সাথে রাশিয়ার ওপর আরোপিত পশ্চিমাদের বিধিনিষেধের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের ও তেলের সরবরাহ কমে যাবে, বাড়বে দাম৷ তখন বাংলাদেশকেও বেশি দামে এগুলো কিনতে হবে, যা দেশের ভেতর মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়িয়ে দিতে পারে৷

ইউরোপ তথা ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) কিভাবে রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক বিধিনিষেধ কার্যকর করবে, তার ওপর নির্ভর করবে তাদের বাণিজ্য নীতির কিছু সাময়িক পরিবর্তন৷ সেই পরিবর্তন বাংলাদেশের ওপর কতটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে তা এখনই বোঝার কোনো উপায় নেই৷

যুদ্ধের প্রভাবে ইউরোপের সামগ্রিক চাহিদা কমবে, কেননা, ইউরোপের জ্বালানি তেলের বড় উৎস হলো রাশিয়া৷ অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া থেকে তেল আমদানি ব্যাহত হলে ইউরোপকে বিকল্প উৎস থেকে বাড়তি দামে তেল কিনতে হবে৷ তাতে বিশ্ববাজারে তেলের দাম আরো বাড়বে, যা মূল্যস্ফীতি বাড়াবে৷ তেলের পাশাপাশি খাদ্যশস্য, বিশেষত গমের সরবরাহ কমে যাওয়ার আশঙ্কা আছে, যা খাদ্যের দাম বাড়াবে৷ তেল ও খাদ্যের বাড়তি দাম মেটাতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই বিপুল সংখ্যক মানুষ অন্যান্য ব্যয়ে কাটছাঁট করবে৷ তার নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের রপ্তানিতে পড়তে পারে৷

বাংলাদেশের মোট বিশ্ব বাণিজ্যের এক-পঞ্চমাংশ সম্পন্ন হয় ইইউভুক্ত দেশগুলোর সাথে৷ আর ইইউতে বাংলাদেশের রপ্তানির প্রায় ৯০ শতাংশ হলো বস্ত্র ও তৈরি পোশাক৷

দুই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্ব স্ব দেশের রপ্তানিকারকদেরকে তাদের স্বদেশীয় মুদ্রায় পাওনা মিটিয়ে দেবে আর তিন মাস অন্তর হিসেব সমন্বয় করবে৷ তবে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর পশ্চিমা দেশগুলো এখন যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তা পাশ কাটিয়ে কারেন্সি সোয়াপ করে বাণিজ্য কতটা করা যাবে, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে৷

এদিকে যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে পণ্যবাহী জাহাজের ভাড়া ও বিমা মাশুল বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে৷ বাংলাদেশে যেহেতেু পণ্য রপ্তানির পুরোটাই এফওবি (ফ্রি অন বোর্ড) ভিত্তিতে করে থাকে, তাই এগুলো রপ্তানির খরচ বাড়াবে না৷ তবে আমদানির বেশিরভাগই সিএন্ডফিভিত্তিতে (কস্ট অ্যান্ড ফ্রেই্ট) হওয়ায় পণ্যবাহী জাহাজ ভাড়া আমদানিকারকের খরচ বাড়াবে, যার প্রভাব পড়বে আমদানিকৃত পণ্যমূল্যে৷ ফলে আমদানি ব্যয় বাড়বে, যা বাণিজ্য ঘাটতিও বাড়াবে৷