সমাবর্তন: উচ্ছ্বাসের আলোকছটার দিন

0
183
সমাবর্তন: উচ্ছ্বাসের আলোকছটার দিন

সমাবর্তন”এর অর্থ হচ্ছে “এক সাথে মিলিত হওয়া” সমাবর্তনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা জীবন শেষে আনুষ্ঠানিকভাবে মূল সনদপত্র দেয়া । এ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া শেষ করে, ডিগ্রি অর্জনের যোগ্যতা অর্জন করে। সমাবর্তনের আরেক নাম উল্লাস উচ্ছ্বাসের আলোকছটার দিন।নানা  ভাবে শিক্ষার্থীরা আনন্দ করে । মহোৎসবে মেতে উঠে সবাই।

সমাবর্তন মিলন মেলায় জীবনের পুরনো দিনে পাতায় নানান স্মৃতি পাখা মেলে মনের দুয়ারে। এক পলকে হারিয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কাটানো হাজারো স্মৃতিময় সময় গুলোতে, চোখে পরবে নিজেদের রেখে যাওয়া পুরোনো ক্যাম্পস। মুহূর্তের মধ্যে কালো গাউন, টুপি , পরা গ্র্যাজুয়েট আর ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক শব্দে ভরে উঠে গোটা ক্যাম্পাস। শিক্ষার্থীরা সমাবর্তন গাউন পরে শিক্ষক, পিতা-মাতা বা অভিভাবকদের সঙ্গে ছবি তোলে।ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে ছবি তোলায় ব্যস্ত থাকে সবাই। একক, দ্বৈত,গ্রুপসহ বিভিন্ন ধরনের ও ভঙ্গিতে ছবি তোলা হয়।ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক মাধ্যমে, যেন দেখে মনে হবে ছবি তোলার প্রতিযোগিতা চলছে। এ দৃশ্য দেখে আর উপভোগ করার অপেক্ষায় থাকে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের ক্যাম্পাস গ্র্যাজুয়েটরা। র্দীঘদিনের লালিত স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমার্বতনে । সমাবর্তন উপলক্ষে অংশগ্রহণকারী গ্র্যাজুয়েটদের পদভারে মুখর হয়ে উঠে গোটা ক্যাম্পাস। যেখানে অংশ নিতে যাচ্ছে হাজার হাজার গ্র্যাজুয়েটরা।

গ্র্যাজুয়েটরা সমাবর্তন নিয়ে বিভিন্ন অনূভূতির প্রকাশ করে । তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোর কথা স্মৃতিচারন করে। অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, অনেকে ক্ষোভও প্রকাশ করে। অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে যা শিখেছে তার অভিজ্ঞতার কথা বলে যা অন্য কোথাও থেকে শেখা যেত না। সমাবর্তনের মাধ্যমে সনদ নিতে আবারও ক্যাম্পাসে ফিরে আসা সে অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে অনেকে আবেগপ্রবন হয়ে যায় ।

সমার্বতনে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনেক এগিয়ে, প্রায় প্রতি বৎসর অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমার্বতনের অয়োজন করে থাকে। বাংলাদেশের শত বৎসরের পুরাতন বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৯ সালে  ৫২তম তম সমাবর্তনের আয়োজন করে ।চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ ২৮ বছর পর ১৯৯৪ সালে প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সবশেষে ২০১৬ সালে চবির চতুর্থ ও শেষ সমাবর্তনটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ৫৪ বছরের ইতিহাসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়েছে মাত্র ৪টি সমাবর্তন। ১৯৬৮ সালে প্রকৌশল কলেজ, ১৯৮৬ বাংলাদেশ ইন্সটিটউট , অতপর ২০০৩ চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)-এর ৪র্থ সমাবর্তন হয় ২০১৯ সালে। বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ষাট বৎসরে ১১তম  সমাবর্তনের আয়োজন করে ২০১৯ সালে।  ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি ২০২১ সালে ২৩তম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। সরকারের অনুমোতি ছাড়া যে সমাবর্তনের আয়োজন করা যায় না তা অনেকেই জানেনা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং সাবেক শিক্ষার্থীদের নিকট এই মাহেন্দ্রক্ষণটি একটি আবেগময় উৎসবের।বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ও রাষ্ট্রপতির হাত থেকে বা তাঁর প্রতিনিধি থেকে মেধার স্বাক্ষর রাখার জন্য সনদপত্র গ্রহণ করা জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় সময়। এমন সময় সারাজীবনে একবারই আসে। বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে সমাবর্তনের সব প্রস্তুতির কাজ চলে র্দীঘ দিন থেকে দিনভর। সমাবর্তন এলাকা, একাডেমিক-প্রশাসনিক ভবন, হলসমূহ, রাস্তাসহ প্রবেশদ্বারে থাকে আলোকসজ্জার ব্যবস্থা । বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস সাজে নতুন সাজে ,পরিনত হয় নবীন-প্রবীণের মিলনমেলায় ।

সমাবর্তন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান।অনুষ্ঠানে আচার্য সনদ অর্জনকারিদের উদ্দেশে বিশেষ অভিভাষণ দেন । সমাবর্তনে নিজ নিজ ক্ষেত্রে খ্যাতিমান ব্যক্তিরা সমাবর্তন বক্তা হিসেবে সনদ পাওয়া ব্যক্তিদের উদ্দেশে দিকনির্দেশনামূলক বক্তৃতা দেন।বক্তারা শিক্ষার্থীদের ইতিবাচক ধারণা চর্চার আহ্বান জানান। সমাবর্তনে বিশেষ আকর্ষণ হল সর্বজনবিদিত গ্রহণযোগ্য একজন বক্তা, যার বক্তব্য গ্রাজুয়েটদের পেশা জীবনে প্রবেশের প্রারম্ভে উদ্দীপক হিসেবে কাজ করবে। যার জীবনী থেকে গ্রাজুয়েটরা উৎসাহ-উদ্দীপনা পাবে সফল মানুষ হওয়ার। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন অনুসঙ্গসম্পন্ন সমাবর্তনের ইতিহাস বিরল। সমার্বতন কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং সাবেক শির্ক্ষথীদের জন্য সামনের এগিয়ে চলার দূরন্ত প্রেরণা। সমাবর্তনের বক্তা নির্বাচনের ক্ষেত্রে আামাদের দেশে আমরা যে মানদন্ডে দেখি অন্য দেশ গুলি তা করে না । সমাবর্তন অনুষ্ঠানের কয়েক হাজার তরুণ-তরুণীর সামনে যে কথাগুলো বলেন সে কথাগুলো সবাই শুনতে চায়। কারন পৃথিবীর সম্পদ হচ্ছে জ্ঞান, আর জ্ঞানী-গুনীদের থেকে জ্ঞানগর্ভ কথাই সবাই প্রত্যাশা করে। বিশ্ববিদ্যালয় ভেবে চিন্তে নতুন জীবনের সন্ধিক্ষণে কিছু উপদেশ দিতে পারবেন যিনি তাঁকেই ডাকেন ।গ্র্যাজুয়েটরা সেখান থেকে ভবিষ্যৎ পথের সন্ধান খুঁজতে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয় সারা বিশ্বের একটি বিদ্যালয়। ইংরেজিতে এ বিদ্যাপীঠটি আরও বেশি ব্যাপক, ইউনিভার্সিটি। অর্থাৎ পুরো ইউনিভার্স বা বিশ্বব্রহ্মান্ডের বিদ্যাপীঠ। এ নামকরণটি কিন্তু শুধু শুধু করা হয়নি, যখন একটি বিশ্ববিদ্যালয় কল্পনা করা হয় সেখানে কিন্তু সংকীর্ণতার কোনো স্থান নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হতে হয় সত্যিকার অর্থে সারা বিশ্বের নাগরিক। দেশ, কাল, ধর্ম, বর্ণ, জাতি, সম্প্রদায় এ রকম কোনো বিভেদ লালন করে কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়া যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে নিজেকে পৃথিবীর সব বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে কল্পনা করে নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল উদ্দেশ্য নিজ নিজ ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতে শেখানো।নতুন জ্ঞানের অনুসন্ধান ।

১২ শতকের দিকে ইউরোপে যখন প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তখন থেকেই সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বিশেষ ধরনের পোশাকের প্রচলন শুরু। আধুনিক শিক্ষার জ্ঞানতাপসদের তীর্থস্থান ছিল আন্দালুস। যখন ইউরোপ ছিল অজ্ঞতার অতল সমুদ্রে নিমজ্জিত, তখন আন্দালুস ছিল শিক্ষা ও সভ্যতার স্বর্গরাজ্য।ইউরোপের সম্রাটরা তাদের শাহজাদা-শাহজাদিদের প্রেরণ করত আন্দালুসে। ইউরোপ থেকে দলে দলে শিক্ষার্থীরা আগমন করত আন্দালুসে।বর্তমানে এটি স্পেন ও পর্তুগালের অংশ।আন্দালুসের মুসলিম পণ্ডিতরা স্বীয় ছাত্রদের শিক্ষাদান শেষ করতেন, তখন সমাবর্তন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। আর এই সমাবর্তন অনুষ্ঠানের যারা সনদ প্রদান করেন এবং যারা সনদ অর্জন করেন, তাদের বিশেষ গাউন পরতে হতো। মাথায় চারকোণা বিশিষ্ঠ ছাতাওয়ালা একটি টুপি পরে। গায়ে জুব্বার মতো ঢিলেঢালা গাউন পরে। এগুলো পশ্চিমা অনুকরণ অনেকে মনে করে।পশ্চিমা ঐতিহাসিকদের লিখনীতে পাওয়া যায় ভিন্নতথ্য। প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক জ্যাক গোডি তাঁর লিখিত বই ‘Islam In Europe’-এর মধ্যে বলেন, আজও পর্যন্ত আরবদের পোশাক জ্ঞানগর্বমূলক মর্যাদায় অন্যতম প্রতীক হিসেবে বিবেচিত । বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমাবর্তন অনুষ্ঠানমালায়।শিক্ষার স্তরের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য ১৪ শতকের দিকে সমাবর্তনের টুপির সঙ্গে ট্যাসেল বা রেশমি থোবার প্রচলন শুরু হয়। একজন শিক্ষার্থী স্নাতক শেষ করার পর ট্যাসেলটি ডান থেকে বাঁয়ে সরাতে পারেন। গ্র্যাজুয়েশনের আগে এই ট্যাসেল একজন শিক্ষার্থীর জন্য সময়ের প্রতীক। যখন এটিকে এক পাশ থেকে অন্য পাশে সরানো হয়, তখন ডিগ্রি সম্পন্ন হয়েছে বলে মনে করা হয়। সাধারণ এই ব্যাপার ধীরে ধীরে ঐতিহ্য হয়ে উঠেছে। গ্র্যাজুয়েটরা বিভিন্ন রুপে ও নানা রঙে পোশাক পরে।মুসলিম শিক্ষানবিসদের সমাবর্তনীয় এই রীতি পশ্চিমে পুরোপুরি গ্রহণ করে।যা গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। ইউরোপ থেকে পুরো বিশ্বে। এভাবেই  মুসলিমদের প্রচলনকৃত এই সভ্যতা আজ এককভাবে পশ্চিমাদের সভ্যতা হয়ে যায়!এই রীতিতেই সব গ্র্যাজুয়েটরা পোষাক পরে।তবে ডিগ্রির স্তরভেদে অনুযায়ী গাউনেরও রকমফের হয়।

গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করে শিক্ষার্থীরা সবাই মিলে একসাথে তাদের গ্র্যাজুয়েশনের টুপি শূন্যে ছুঁড়ে মারা একটি অতি প্রচলিত রেওয়াজ। । ১৯১২ সালে অনুষ্ঠিত ইউএস নেভাল অ্যাকাডেমির শিক্ষার্থীরা এক গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠানে শূন্যে পুরনো টুপি পুরনো পদবীকে বিদায় জানাতে ছুঁড়ে এবং আর সেগুলোকে সংগ্রহেরও প্রয়োজন বোধ করল না। কারন অফিসারদেরকে একটি নতুন টুপি দেওয়া হতো। সমাবর্তন অনুষ্ঠানে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করা শিক্ষার্থীরা শূন্যে টুপি ছুঁড়ে মেরে আসলে নতুন প্রাপ্ত কোনো না কোনো পদবীকে অভ্যর্থনার জন্য ।  তাদের দেখাদেখি পরবর্তীতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করা শিক্ষার্থীরাও একই রীতি মেনে চলতে থাকে, এবং কালের বিবর্তনে এক পর্যায়ে এই ছেলেমানুষি রীতিটিই পরিণত হয় একটি ঐতিহ্যে।

একটি বিশ্ববিদ্যালয় দেশ ও জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্র । বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান তৈরী ও বিতরনের কেন্দ্রস্থল । এইখানেই জ্ঞানী-গুনী তৈরী হয়। বিশ্ববিদালয়ের কাজ যুক্তি ও সত্যের অনুসন্ধান। নতুন নতুন জ্ঞান সৃজন এবং মানবকল্যাণে তার ব্যবহার। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্য অর্জন জাতিকে যেমন অনুপ্রাণিত করে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শির্ক্ষাথীদের অপ্রত্যাশিত আচরন ও ঘটনা সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সমাবর্তন শিক্ষাজীবনের অর্জনের স্বীকৃতি প্রাপ্তির উৎসবের দিন। জ্ঞানী-গুনীর স্বীকৃতির দিন। এক স্মৃতিবহুল দিন । এই সমাবর্তনের একটি দিনই শির্ক্ষাথীদের একটি জীবনের শেষ আরেকটি অধ্যায় শুরু । শুরু হউক  বিকশিত হউক মানবকল্যাণে ।

শির্ক্ষাথীদের শিক্ষা জীবন শেষের আনুষ্ঠানিকতা ’সমাবর্তন’ প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই আনুষ্ঠানিকতা হউক প্রতি বৎসর ।

-সরওয়ার জাহান