বিশ্বের সর্ববৃহৎ দেশ রাশিয়ায় প্রায় আড়াই কোটি মুসলমান বসবাস করে। এখানে ইসলামী আর্থিক প্রতিষ্ঠান থাকলেও কোনো ইসলামী ব্যাংক ছিল না। প্রথমবারের মতো শুক্রবার ১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ থেকে দেশটি দুই বছরের জন্য পরীক্ষামূলক ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করছে।
মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক প্রচার মাধ্যমে প্রকাশিত অআল এরাবিয়া এবং আ ল জাজিরার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। এতে বলা হয়,রাশিয়ার সংসদের নিম্নকক্ষ দেশটির বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একটি পরীক্ষামূলক ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু করার জন্য একটি বিল পাস করেছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন গত ৪ আগস্ট ২০২৩ ইসলামী ব্যাংক চালু করতে এর ‘সম্ভাব্যতা’ মূল্যায়ন বিষয়ক একটি আইনে স্বাক্ষর করেন। পরীক্ষামূলক কার্যক্রমটি দেশটির মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ চারটি প্রজাতন্ত্র তাতারস্তান, বাশকোর্তোস্তান, চেচনিয়া ও দাগেস্তান চালু করা হবে। এসব প্রজাতন্ত্রে ইসলামী লেনদেন চালু ছিল ।এখানে সফল হলে এর কার্যক্রম দেশের বাকি অঞ্চলে চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে।
ইসলামী ব্যাংকের কার্যক্রম ইসলামী শরিয়াহর নির্দেশনায় পরিচালিত হয়। ইসলামী আইনে সুদি কারবার করা নিষিদ্ধ এবং সুদ চার্জকে অন্যায্য বিবেচনা করা হয়। প্রচলিত আর্থিক কার্যক্রম ঋণভিত্তিক হয়ে থাকে এবং এর লেনদেনের পুরো ঝুঁকি ও দায় গ্রাহক বহন করে। বিপরীতে ইসলামী ব্যাংকিং সম্পদভিত্তিক হয়ে থাকে। এর আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও গ্রাহক উভয়ে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে লাভ ও ঝুঁকি ভাগ করে নেয়।
রাশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব এক্সপার্টস ইন ইসলামিক ফাইন্যান্সের নির্বাহী সম্পাদক মাদিনা কালিমুলিনা বলেন,‘গ্রাহকের আর্থিক সমস্যা ও দেউলিয়াত্ব থেকে কোনো ব্যাংক উপকৃত হতে পারে না। অথচ প্রচলিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রায়ই তা ঘটছে।
ইসলামিক অর্থব্যবস্থা অংশীদার ভিত্তিক সম্পর্ককে উৎসাহিত করে, যা প্রচলিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে খুব কমই হয়। তা ছাড়া ইসলামিক ব্যাংকিং সমাজের জন্য ক্ষতিকর খাত যেমন মদ, তামাক এবং জুয়ার অর্থায়ন করে না। আরেকটি মৌলিক পার্থক্য হলো,ইসলামী ব্যাংকিং কোনো কাল্পনিক,বা প্রকৃত নয় এমন সম্পদের ক্ষেত্রে অর্থায়ন করে না। এতে আর্থিক সংকটের সূত্রপাত হয়।
ইসলামি বিশেষজ্ঞরা বলেন,‘ক্রমবর্ধমান বাজারের নিয়ন্ত্রণ এবং বিনিয়োগকারী ও ক্লায়েন্টদের সুরক্ষা প্রয়োজন। কিন্তু ইসলামিক অর্থব্যবস্থা মার্কেট বন্ধকি অর্থায়ন এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের জন্য রাষ্ট্রীয় সহায়তা কর্মসূচির সুবিধাগুলো ব্যবহার করতে পারে না। কারণ সেগুলো সবই সুদ বহনকারী ঋণের ওপর নির্ভরশীল যা শরিয়তের পরিপন্থী। রাশিয়ার গৃহীত আইনে এসব বাধার আংশিক সমাধান করা হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, পরীক্ষামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে ইসলামী অর্থ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন আরো বিস্তৃত হবে। রাশিয়ার সবচেয়ে বড় ঋণদাতা সবের ব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ওলেগ গেনেভ জানিয়েছেন, ইসলামিক ব্যাংকিংয়ে ক্ষেত্রে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ৪০ শতাংশ রয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে তা ৭.৭ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছার আশা করা হচ্ছে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভিজিটর ডায়ানা গ্যালিভা জানিয়েছেন, ২০০৮ সালে আর্থিক সংকটের মুখোমুখি হওয়ার পর থেকে রাশিয়ায় ইসলামিক ব্যাংকিং কার্যক্রম চালুর বিষয়টি আলোচনায় আসে। সেই সময় ব্যাংকগুলো তারল্য ঘাটতির মুখোমুখি হয় এবং নগদের বিকল্প উৎস খোঁজা শুরু হয়। আর্থিক সংকট কাটাতে তখন থেকে ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা করছিল দেশটির আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ইসলামী অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল করার পর রাশিয়ান ব্যাংকগুলি পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার অতিরিক্ত চাপ অনুভব করেছিল। যার ফলে রাশিয়ান ব্যাংক অ্যাসোসিয়েশন দেশটিতে ইসলামী ব্যাংকিংকে অনুমতি দেওয়ার এবং ইসলামী ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে একটি শরিয়া কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেছিল। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, রাশিয়ায় ইসলামি ব্যাংকিং বাস্তবায়ন পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা মোকাবেলা করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার জন্য একটি সুচিন্তিত উদ্যোগ। সামপ্রতিক ইউক্রেন যুদ্ধ এবং রাশিয়ার অর্থনীতির ওপর পশ্চিমা চাপের ঘটনা এ প্রক্রিয়াকে আরো ত্বরান্বিত করে।