আসছে বৈশাখ, শুভ হালখাতা ও বর্ষপঞ্জির কথা- আবসার হাবীব

0
1079

১.

স্বাগতম শুভ নববর্ষ। বৈশাখের নতুন সূর্যোদয়ের সাথে সাথে শুরু হয়েছে বাংলা ১৪২৫ সাল। শেষ হলো একটি বছর। গত বছরের হাসি-কান্না, স্মৃতিকণা ভেসে উঠে মনে। মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের চাওয়া ও না-পাওয়া, সংসার জীবনের সুখ-দুঃখ, পারিবারিক জীবনের ছোট-খাট ঘটনা, মান-অভিমান, জাতীয় জীবনের সাফল্য আর ব্যর্থতার চিত্র – সবই মনে পড়ে।

আমরা সব সময় পুরাতনকে বিদায় জানিয়ে আহ্বান করি নতুনকে। বিগত দিনের পুরাতন আর জরাজীর্ণকে মুছে ফেলে মানুষ নতুন আশা-আকাঙ্খা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কথা ভাবে। নতুনভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখে।

বাংলা নববর্ষ আসে ছয় ঋতু আর বার মাস পেরিয়ে। গ্রীষ্মের পরে বর্ষা, শরতের পরে হেমন্ত, আসে শীত, আসে ঋতুরাজ বসন্ত। এই ছয় ঋতু নিয়েই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা বাংলাদেশ। বাংলা নববর্ষ বাঙালির জাতীয় উৎসবের দিন। এ এক অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দিন। উজ্জ্বল হালখাতার দিন।

২.

গ্রামীণ সাংস্কৃতিক জীবনধারা এখনো প্রবহমান রযেছে মেলা, হালখাতা প্রভৃতি অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। এইসব অনুষ্ঠান ছিল সর্বসাধারণের। উৎসবমুখর পহেলা বৈশাখের অন্যতম আর্কষণ হালখাতা খোলা। ব্যবসায়ীরা হাটে-বাজারে দোকানে হালখাতা খুলে এই দিনে। সাজসজ্জা হয়, মিষ্টি বিতরণ করে।

শুভ হালখাতা। এই অনুষ্ঠান বিশেষ করে ব্যবসায়ী মহলে এক বিশুদ্ধ বাঙালি উৎসবের আমেজ নিয়ে আসে বাংলা বছরের প্রথম দিনটিতে। মুদি, মিষ্টির দোকানী, কাপড় বিক্রেতা সবার মাঝে উৎসাহ উদ্দীপনার কমতি থাকে না। লাল-নীল-হলুদ কাগজের বিচিত্র বর্ণের বাহারী নক্সা ও ফুল-পাতায় সাজানো গোছানো দোকান, একটু হৈ হুল্লোড়। সবকিছু মিলিয়ে বেশ উৎসবমুখর ওই সকালে দেখা যায় দোকানের প্রবেশপথে ব্যবসায়ীরা লুঙ্গি-পাঞ্জাবী বা ধূতি-পাঞ্জাবী পরে খোসমেজাজে বসে আছেন। ক্যাশবক্স লালসালু কাপড়ে মোড়া লম্বাটে হালখাতা নিয়ে।

অতিথিরা এসেই প্রথমে খাতায় নিজের নামের পাশে লেখা বাকীর অংশ দেখেন, কেউ শোধ করেন পুরোপুরি, কেউ আংশিক। এর ভেতরেই চলতে থাকে খাওয়া-দাওয়া, মিষ্টি, নাড়–, চালভাজা, চলে গল্প-গুজব, হাসি-ঠাট্টা। ঋণ শোধের কথা বহু বিচিত্র বর্ণের আমন্ত্রণ লিপিতেই উল্লেখ থাকে। তাও আবার ছন্দোবদ্ধ সাধুভাষায়, ‘আসিতেছে শুভদিন। দিনে দিনে বহু বাড়িয়েছে দেনা, গুণিতে হইবে ঋণ’। কিসের সাথে কী?

৩.

আর মেলা শুধু পহেলা বৈশাখের দিন বসে না। সারা বৈশাখ মাস ধরে বসে। দেশের অঞ্চলে নানান নামের মেলার আয়োজন হয়। এইসব মেলায় পশরা সাজিয়ে বসে দোকানীরা। মেলায় আসে চিনির তৈরী নানান রকমের নকশা খাবার-কদমা, বাতাসা, লিচু, আম, ঘোড়া, হাতি, মাছ, কলসী ইত্যাদি।

আর ওঠে তালপাতার সেপাই, বাঁশী, পাখি, টমটমি, চরকী এবং বাঁশ, বেত, পাট, শীতল পাটি,  হাতপাখা, দা-ছুরি, কাঠের তৈরী প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র। মাটির নকশা করা হাঁড়ি, বাটি, বাসন-কোসন, গাছের ফুলের চারা। নানান রকমের খেলনা থেকে সংসারের টুকিটাকি সবই মেলায় পাওয়া যায়। অনেকে বছরে একবার মেলা থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে থাকে। মেলায় নাগর দোলা, ডুগডুগি বাজিয়ে খেলা, পুতুল নাচ, ষাঁড়ের লড়াই, যাত্রা, সার্কাস – এইসব আজো নির্মাণ করে চলেছে মেলার পরিবেশ।

৪.

বাংলা বর্ষপঞ্জি প্রবর্তনের ব্যাপারে পাওয়া সমর্থিত তথ্য এরকম : মোঘল বাদশাহ আকবরের সময় ভূমি রাজস্ব সংক্রান্ত  জটিলতা দুর করা এবং ফসলের মৌসুমকে সৌরপঞ্জির দ্বারা একটি নির্দিষ্ট আবর্তনে সমন্বয় করার জন্যে নতুন বর্ষপঞ্জির আবশ্যকতা দেখা দেয়। এই সময় রাজা টোডরমল বঙ্গ দেশে ভূমি রাজস্বের জন্যে বিশেষ সংস্কার মূলক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাব করেছিলেন।

একটি নির্দিষ্ট ক্ষণে তথা ফসলের মৌসুমে প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময়ে যাতে বাংলার কৃষকেরা তাদের ভূমি রাজস্ব আদায় করতে পারে সেজন্যে এই নতুন বর্ষপঞ্জি উদ্ভাবন করা হয়েছিল। চান্দ্র বর্ষ বা হিজরী বর্ষকে একটু পরিবর্তন করে সৌর-বর্ষে পরিণত করার মধ্য দিয়ে বাংলা বর্ষপঞ্জি চালু করা হয়েছে। কোন কোন সূত্রমতে বাংলা সনের প্রবর্তক হিসেবে ফতেহ উল্লাহ সিরাজী-র ( যিনি বাদশাহ আকবরের ভূমি ও স্বরাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন) নাম উল্লেখ করা হয়।

বাংলাদেশে বর্ষপঞ্জি সংস্কারের জন্যে বাংলা একাডেমী ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে দিয়ে বর্ষপঞ্জি সংস্কারের উপ-সংঘ গঠন করে। এই উপ-সংঘ বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রধান ত্রুটি হিসেবে দেখলো যে, খিষ্ট্রিয় সালের সাথে বাংলা সনের তারিখ বরাবর স্থির ও অভিন্ন রাখা যাচ্ছে না। বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোতে বাংলা তারিখ ও ইংরেজী তারিখ এক থাকছে না। অনেক চেষ্টার পরেও একবার পহেলা বৈশাখ হচ্ছে ১৪ এপ্রিল, আরেকবার হচ্ছে ১৫ এপ্রিলে। এবং ২১ ফেব্রুয়ারির ক্ষেত্রে তাই। এই গরমিল এখনো থেকে গেছে।

তবে, বাংলা বর্ষপঞ্জির সাথে আমাদের পরিচিত হতেই হবে। যদিও পৃথিবীর সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে আমাদেরকে পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি প্রবর্তিত গ্রেগারিয়ান ক্যালেন্ডার বা ইংরেজী বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী কাজ করতে হচ্ছে। গ্রামের কোটি কোটি জনগণ আজও বাংলা তারিখ মেনেই চলেন। কৃষকদের কাজের পরিকল্পনা সবকিছুই বাংলা তারিখ দিয়েই হয়। আর সবচেয়ে বড় কথা, ঋতু পরিবর্তন-এর সম্পর্ক যেন এই বাংলা মাসের সাথেই শুধু বিশেষভাবে জড়িত।

৫.

বৈশাখের প্রথম দিন সকালে চাউল, আখের গুড় ও নারিকেল দিয়ে ক্ষীর রান্না করে এর সাথে ফুলপিঠা, ঝিকিমিকি পিঠা, পাতার পিঠা খাওয়া হয়। দুপুরে সব ধরনের শাক-সবজি দিয়ে লাবড়া রান্না করে এবং মাছ, মাংস, দুধ, মিষ্টি খাওয়া হয়। সবাই বিশ্বাস করে যে, বৎসরের প্রথম দিন ভাল খাবার খেলে, সারা বৎসর ভাল খেতে পারবে। এমন ধারণাও প্রচলিত রয়েছে যুগ যুগ ধরে। ব্যবসায়ীরা হালখাতা করে। পায়েস রান্না করে মিষ্টিসহ ক্রেতাদের দাওয়াত করে খাওয়ায়।

পহেলা বৈশাখ ঘুম থেকে উঠে কাপিলা গাছের ফল খেতে দেয়। খেলে চর্মরোগ হয় না। তিতা জিনিষ খায়। মিষ্টি রান্না হয়। বাঙি খাওয়া হয়। কোন কোন এলাকায় পহেলা বৈশাখে মাংস রান্না হয়।

পহেলা বৈশাখ বিভিন্ন শাক, বিশেষ করে তিতা জাতীয় শাক। যেমন: গিমা শাক খায়। মাছ-মাংস খায় না অনেকে। পাট শাকের সাথে কাসুন্দি খুবই জনপ্রিয় খাওয়া। যারা বৈশাখ মাসে টক খাবে, তাদের শরীর ভাল থাকবে। সাজনা, চেপার শুটকি আলু দিয়ে রান্না করে কিংবা কচি মিষ্টি কুমড়া শুটকী করে খাওয়া হয়। করলা ভাজা পান্তা ভাতের সাথে বেশী খাওয়া হয়। বেশ মজাও। পান্তা-পিঁয়াজ খাওয়ার কোনো তুলনা হয় না। পান্তা ভাতের সাথে গোটা পিঁয়াজ ছিলে, ছোট আলু ভেজে ভর্তা ও শুকনো মরিচ পুড়ে পান্তাভাত মাখিয়ে খাওয়ার রেওয়াজ এখনো কোথাও কোথাও খুবই জনপ্রিয়।

কাঁঠালের তরকারি শুকনো সীমের বিচির সাথে ১০১ প্রকার তরকারি রান্না হয়। শুধু শাকই থাকে সাত রকমের। তবে, বৈশাখ মাসে সীম খেতে হয় না। সীমের বিচিও না। প্রবাদ আছে- সীম আর সীম থাকে না। তখন মহিশের শিং হয়ে যায়।

বৈশাখ মাসে কাঁচা  আমের চাটনি বলতেই জিবে জল এসে যায়। কুচি কুচি করে কেটে কাসুন্দি দিয়ে, শুকনা মরিচ পোড়া ও লবন দিয়ে মেখে খেতে সবাই ভালবাসে। মজাদারও। কাঁচা কাঠালের তরকারির কথা না-ই বা বললাম।

সারা বৈশাখ মাস জুড়ে এসব মজার রান্না খেতে ভুলবেন না। সবশেষে পাঠকের জন্য একটি প্রবাদ-

“চৌধুরী বাড়ির খাট্টা

আকাশে মারে ঠাট্টা।”

লেখক: কবি ও এনজিও কর্মী।