অন্যরকম শিক্ষার সন্ধানে

0
468

মুক্তকথা

অন্যরকম শিক্ষার সন্ধানে : ফারহানা মান্নান

আমার এক বোনের জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা প্রবাসে। ওর মা একদিন গল্পে গল্পে জানালেন যে, ওর যখন বয়স ৪ কি ৫ তখন প্রতিদিন স্কুলের একাডেমিক পড়াশোনা শুরু হতো গল্প দিয়ে। অর্থাৎ গল্প বলতে হতো শিক্ষার্থীদের। প্রতিদিন স্কুলে আসার পথে তারা তাদের চারপাশে কি দেখেছে তাই নিয়ে গল্প। বড় হয়ে আমার সেই বোনকে দেখেছি যেকোনও ঘটনা খুব সুন্দর করে বলতে জানে। এটা সামাজিক প্রেক্ষাপটে একটি চমৎকার গুণ বটে! এইতো গেলো গল্প বলা। আমি শুনেছি রঙ দিয়ে আঁকিয়ে ওদের মনের কত গল্পই না ওদের শিক্ষক জানতেন। এই জানাটা শিক্ষকদের তাদের শিক্ষার্থীদের মনের গভীরের মানুষটিকে আবিষ্কার করতে সাহায্য করেছে। আর এটা যারা চারিত্রিকভাবে লাজুক স্বভাবের অথবা কম কথা বলার মানুষ তাদের জন্য এই ছবি আঁকবার পদ্ধতি একেবারেই মোক্ষম।

যারা টেলিভিশন দেখেন তারা জানেন, টেলিভিশন চ্যানেলে (বিদেশি) ক্রাইম-পেট্রোল নামক এক অনুষ্ঠান দেখানো হয়। একবার দেখা গেল একটি শিশু স্কুলে হঠাৎ করেই অদ্ভুত আচরণ শুরু করে। সব সময় শঙ্কিত থাকে। কারও সাথে তেমন কথাও বলে না। এই শিশুর পরিবারে ঘটে যাওয়া এক অপরাধের খোঁজ নিতে গিয়ে পুলিশ সেই শিশুর বই-খাতা উল্টে পাল্টে দেখা শুরু করে যে সে কোথাও কিছু লিখেছে কিনা। পরে শিশুটির এক সহপাঠীর কাছ থেকে জানতে পারে যে, সে তার মনের কথাগুলো স্কুলের পেছন দিককার একটি দেয়ালে আঁকে। সেখানে গিয়ে পুলিশ যা দেখে পরবর্তীতে প্রকৃত ঘটনার সাথে তা হুবহু মিলে যায়।

ছবির মধ্য দিয়ে যে কেবলমাত্র একজন শিশু বা শিক্ষার্থীদের মানসিকতার সন্ধান পাওয়া যায় এমন নয়। মস্তিষ্কের গঠনে, এমনকি লেখাপড়ার বিভিন্ন বিষয়ে এই ছবি আঁকা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ায় দেখা গেছে যে সকল শিশু ছবি আঁকার সাথে যত বেশি জড়িত তারা তত বেশি আচরণের দিক থেকে সাবলীল। আরও দেখা গেছে, ক্যালিফোর্নিয়ার যে সকল তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীরা একটি বিশেষ আর্ট প্রোগ্রামে অংশ নিয়েছে, পরবর্তীতে সেই সকল শিশুদের পঠন ক্ষমতার উন্নতি হয়েছে অন্যান্য শিশুদের চাইতে অনেক বেশি। আরও দেখতে এই ওয়েবসাইটে যেতে পারেন। (ক্লিক করুন: http://goo.gl/vyJ5D1)

স্কুলে যারা দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে তাদের জন্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। এটা তাদের ভাষাগত দক্ষতা সহ আরও অন্যান্য দক্ষতা অর্জনে ভূমিকা রাখবে। আর সেটা ছবি আঁকার মাধ্যমেই। এই যেমন, যখন শিশুদের গল্প পড়ে শোনাবেন তখন তাদের গল্প শুনে শুনেই ছবি আঁকতে বলবেন। এভাবে একজন শিশুর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানতে পারা সম্ভব হবে। যখন শিশুদের কোনও কাজ দেবেন তখন ব্যাকগ্রাউন্ডে কোনও সফট মিউজিক বাজান। এটা শিশুর কাজের পরিবেশ তৈরিতে টনিকের মতো কাজ করবে। সব থেকে মজার যে কাজটি দেবেন তা হলো ফেলে দেওয়া জিনিস রিসাইকেল করে নতুন কিছু তৈরি করতে দেওয়া। এটা তারা তৈরি করে পছন্দ মতো রঙ দিয়েও রঙ করতে পারে। তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের দারুনভাবে মাল্টিপ্লিকেশন শেখাতে পারেন।

পপস্টিক দিয়ে কিছু তৈরি করতে দিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার সুযোগ তৈরি করে দিতে পারেন।  http://www.tryengineering.org/lessons/popsiclebridge.pdf এজন্য এই ওয়েব সাইটে একটি নমুনা দেওয়া আছে। দেখে নিতে পারেন। আরও একটি মজার কাজ দিতে পারেন, ‘ট্রাভেল ইস্তাহার তৈরি’। যে কোনও বিশেষ স্থানের জন্য দিতে পারেন। ছবি আঁকার মধ্য দিয়ে ইতিহাসও তাদের ঝালাই হয়ে যাবে! এভাবে একেবারে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের ছবি আঁকার মধ্য দিয়েই শেখানোর কাজটা করা যায়।

কাজেই আর্ট বা ছবি আঁকা গুরুত্বপূর্ণ। ছবি আঁকার মধ্য দিয়ে শিশুরা ভাষাগত দক্ষতা অর্জন করতে পারে; মন, শরীর ও আত্মার মধ্যে একটা যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে, নিজস্ব অভিব্যক্তি সম্পর্কে জানাতে পারে যা তাদেরকে কল্পনার জগত থেকে বাস্তব জগতে নিয়ে আসে, তাদের আত্ম-স্বাধীনতার সাথে সাথে বন্ধুদের সাথে পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখবে এটি। তবে আর্টের গুরুত্ব সম্পর্কে খান একাডেমির (https://goo.gl/wR78ZV) এই ওয়েব সাইটে বেশ কিছু আলোচনা হয়েছে সেগুলো পড়তে পারেন। এখান থেকে আর্টের গুরুত্ব সম্পর্কে একটা উক্তি দারুন লেগেছে- Art is a way of pioneering new ways of thinking/viewing the world, unique to its creator. Art is a way of bringing people together।

একটা মজার বিষয় হলো ফেসবুক বা টুইটারের মতো সোশ্যাল মিডিয়া আঁকার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আর সেটা হচ্ছে শিল্পকে ভাগাভাগি করে নেওয়ার মাধ্যমে। নিজের কোনও ছবি সম্পর্কে নানা মন্তব্যের মধ্য দিয়ে নিজের সম্পর্কেই অনেকখানি জানতে পারা যায়। নিজেকে দেখার নানা দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে জানতে পারা যায়। প্লেটো, সক্রেটিস, থেলিস, হেরাক্রিটাসের মতন দার্শনিকেরাও নিজেকে জানার প্রতিই জোর দিয়েছিলেন। আর বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো আমার কাছে নিজেকে জানতে পারার জন্য এক রকম আয়নাই বটে।

এখন অন্য সব দেশের চিন্তা বাদ দিয়ে যদি বাংলাদেশকে দেখি তাহলে স্কুল পর্যায়ে আর্ট নেই এমনটা বলা যায় না। স্কুলে ছবি আঁকানো হয়। কিন্তু এই আঁকা কোনও বৃহৎ পরিসরের লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে হয় না। আমি নিজে স্কুলে পড়াতে গিয়ে দেখেছি এই ছবি আঁকা কতখানি অবহেলিত। আসলে সব কিছুর পক্ষে একটা বৈজ্ঞানিক কারণ অনুসন্ধান করলেই কিন্তু বিষয়টির গুরুত্ব বেড়ে যায় অনেকখানি। যুক্তি ও তর্কের মাধ্যমে কোনও কিছুর সুফল সম্পর্কে জানলে সেই বিষয় সম্পর্কে আস্থা জন্মে। এই আস্থাই আমাদের যে কোনও বিষয়ের জ্ঞান সম্পর্কে সৃজনশীলভাবে ভাবতে সাহায্য করে আর সেই জ্ঞানের প্রয়োগ সম্পর্কেও ভাবায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চাইল্ড কেয়ার সেন্টারে প্রাক শৈশব পর্যায়ের শিশুদের জন্য সিলেবাসের মূল আকর্ষণ হিসেবে থাকে আর্ট। বাংলাদেশে বেশ কিছু এনজিও সংস্থা আর্টের ওপরে তাদের নিজস্ব সিলেবাস তৈরি করে নিয়েছে। এই বয়সের শিশুদের জন্য ক্রিয়েটিভিটি এবং আর্টের ওপরে একটা চমৎকার বই রয়েছে ‘Creativity and the Arts with Young Children’ বইটির লেখক Rebecca T. Isbell Ges Shirley C. Raines। চমৎকার একটি বই। বইয়ের ৫ নম্বর অধ্যায়টি বিশেষভাবে আর্টের ওপরে লেখা হয়েছে। যারা আগ্রহী সংগ্রহ করে পড়ে দেখতে পারেন।

শিল্প বা ছবি আঁকা নিয়ে এই লেখা বেশ নাতিদীর্ঘ। তবু ছবি আঁকা যে কেবল আঁকা, বিনোদন, সময়ক্ষেপণ, শখ বা প্রয়োজন নয়; এটা যে আরও বৃহৎ একটি বিষয় তা হয়তো কিছুটা বোঝা যাচ্ছে। এখন স্কুলের লেখাপড়ার চাপ সামলে ছবি আঁকা নিয়ে আলাদা করে ভাবাটা খুব সহজ নয়। তবু আশা করছি শিক্ষকরা ভাববেন। অনলাইনে এই বিষয়ে প্রচুর সহায়ক তথ্য পাবেন। কেবল সময় নিয়ে কম্পিউটার খুলে সার্চ দিতে হবে মাত্র আর বাকি কাজ শিক্ষার্থীদের। আমরা যদি ছবি আঁকাকে আনন্দদায়ক পাঠদানের জন্য প্রয়োগ করি তাও বোধ করি নেহাৎ কম নয়! এক ছবি আঁকাই কিন্তু শিখনের ক্ষেত্রে হয়ে উঠতে পারে একটি প্রয়োজনীয় শিখন উপকরণ তবে এই উপকরণের সঠিক ও সৃজনশীল প্রয়োগ সম্পর্কে জানতে হবে। যে কোনও কিছুর প্রয়োগ না জানলে ওই যে বলেছিলাম আস্থার কথা, সেটি তৈরি হয় না। কাজেই শিক্ষক হিসেবে নিজ নিজ বিষয় বুঝে ছবি আঁকানোর নানা সৃজনশীল দিক নিয়ে নিজের ভেতরে প্রথমে আস্থা তৈরি করুন।

আমরা দেশের চলমান শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন নিয়ে চিন্তিত থাকি। ভাবি। কিন্তু ভেবে দেখবেন এমন অনেক বিষয় আছে যার জন্য খুব বেশি প্রশিক্ষণ বা সময়ক্ষেপণ বা বিরাট বিরাট প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রয়োজন হয় না। এমনকি নীতিমালায় আক্ষরিক অর্থে উল্লেখ না থাকলেও সমস্যা নেই। যা শেখানোর পক্ষে অভিনব, সৃজনশীল তা প্রয়োগে আশা করি আর যাই হোক কোনও বাধা আসতে পারে না। একটাই আক্ষেপের কথা হয়তো আসতে পারে যে স্কুল পর্যায়ে শিক্ষকদের বেতন অনেক কম। আর এছাড়াও গ্রামের দিকে স্কুলের কাঠামোগত দিকগুলো চিন্তা করলে এমন কিছু বাঁধা আছে যা আমাদের মোকাবিলা করতে হয়। তবু ছবি আঁকতে, শিক্ষার্থীদের গল্প বলাতে, ফেলে দেওয়া জিনিস দিয়ে নতুন কিছু তৈরি করাতে খুব বেশি বড় বাঁধা আসবে কি? আমি মনে করি, না। আমার সাথে হয়তো আরও অনেকে এই বিষয়ে একমত হবেন। চলুন তবে সকলে মিলেই শিখন-শেখানোয় একটা চমৎকার পরিবর্তন আনি। চলুন আমরা ছবি আঁকাই আর ছবি আঁকি!

দখিনা:৩৯

ফারহানা মান্নান : শিক্ষা বিষয়ক গবেষক।