দখিনা প্রচ্ছদ প্রতিবেদন (৩৮)
বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার নামে বাড়ছে জনদুর্ভোগ
সাইফ উল আলম
চট্টগ্রাম মহানগরে জুড়ে ব্যাঙের ছাতার মত গড়ে ওঠা অসংখ্য মানহীন ও অনুমোদনহীন রোগ নির্ণয়কেন্দ্রগুলোর স্বাস্থ্যসেবার নামে বৃদ্ধি করছে জনদুর্ভোগ। এক ধরণের অসাধু চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্মচারীদের যোগসাজশে আর মুনাফালোভী কিছু ব্যবসায়ীদের কারণে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নামে চলছে রমরমা ব্যবসা ও অনিয়ম। তাছাড়া তাদের দালালের খপ্পরে পড়ে প্রতিনিয়ত প্রতারণার শিকার হচ্ছে সহজ-সরল-সাধারণ-দরিদ্র মানুষগুলো। এসব সেন্টারের একদিকে যেমন নেই সংশ্লিষ্ট দফতরের কোন অনুমোদন, নিজস্ব ভবন, একইভাবে নেই পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি এবং প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত দক্ষ জনবল। নেই তদারকি সংস্থাগুলোর কার্যক্রম।
যে কোনো জটিল অপারেশন করে চোখের আলো ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে চট্টগ্রামের অলিগলিতে গড়ে ওঠা লাইসেন্সবিহীন অবৈধ অর্ধশত চক্ষু হাসপাতাল। কিন্তু বেশ কয়েকটি বেসরকারি চক্ষু হাসপাতাল ঘুরে দেখা মেলেনি চিকিৎসার প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের। রোগীর আস্থা অর্জন করতে এসব হাসপাতালে আবার ঝুলিয়ে রাখা হচ্ছে বিদেশি ডিগ্রি নেওয়া নামিদামি চিকিৎসকের নাম। চক্ষু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের চোখ হারানোর শঙ্কাই থাকে প্রবল।
নীতিমালায় কোনো ভবনের নিচে ও সড়কের ২০ ফুট দূরত্বের মধ্যে হাসপাতাল নির্মাণ করার নিয়ম নেই। তবে পুরনো একটি ভবনের নিচতলায় ও সড়কের পাশেই গড়ে তোলা হয়েছে বহদ্দারহাট কমিউনিটি চক্ষু হাসপাতাল। ভবনটির কয়েকটি কক্ষে থাকেন হাসপাতালটির দায়িত্বে থাকা এক ডাক্তারের পরিবারও। পাশের একটি কক্ষে চলে চক্ষু চিকিৎসা! ভেতরে গিয়ে দেখা গেল, বে-কমিউনিটি চক্ষু হাসপাতাল (অলাভজনক দাতব্য চক্ষু হাসপাতাল) নাম সংবলিত আরেকটি সাইনবোর্ড। নগরীর পশ্চিম মাদারবাড়ী এলাকার চট্টগ্রাম আই কেয়ার হাসপাতালটি নির্মাণ করা হয়েছে একটি দশতলা ভবনের নিচতলায়, সড়কের পাশেই। মাত্র দুটি কক্ষেই দেওয়া হচ্ছে চিকিৎসা সেবা।
অনুসন্ধানে যেসব ভুয়া হাসপাতাল বেরিয়ে এসেছে সেগুলো হলো আগ্রাবাদ এলাকার চিটাগাং আই হাসপাতাল, বহদ্দারহাট বড়পুকুর পশ্চিম পাড়ের বহদ্দারহাট চক্ষু হাসপাতাল, দুই নম্বর মাইল এলাকার ন্যাশনাল চক্ষু হাসপাতাল, আগ্রাবাদ কমিউনিটি চক্ষু হাসপাতাল, পাঠানটুলী এলাকার এ্যাপোলো চক্ষু হাসপাতাল, কলেজ বাজার রোডের কর্ণফুলী চক্ষু হাসপাতাল, আগ্রাবাদের সিগমা চক্ষু হাসপাতাল, ইপিজেড এলাকার চট্টগ্রাম সিটি আই হাসপাতাল এবং আগ্রাবাদ চৌমুহনীর ভিশন চক্ষু হাসপাতাল। সিভিল সার্জন অফিসের মহানগর এলাকায় লাইসেন্সপ্রাপ্ত বেসরকারি হাসপাতালের তালিকায় এসব হাসপাতালের নাম নেই। বেসরকারি হাসপাতাল পরিচালনার বিষয়ে ১৯৮২ সালের ‘দ্য মেডিকেল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিক অ্যান্ড ল্যাবরেটরিস রেগুলেশন (অর্ডিনেন্স)’ নীতিমালা বিদ্যমান। এই নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে, প্রাইভেট হাসপাতালের ক্ষেত্রে ১০ শয্যার হাসপাতাল পরিচালনার জন্য তিনজন এমবিবিএস ডাক্তার, ছয়জন ডিপ্লোমা নার্স, ছয়জন আয়া ও তিনজন সুইপার থাকতে হবে। চক্ষু বিশেষজ্ঞরা জানান, চোখের ছানি, লেন্স কিংবা সাধারণ অপারেশন কিছু নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সম্পন্ন করতে হয়। যার জন্য প্রয়োজন ইনডাইরেক্ট অবতালমস্কো, এওবি স্কেল, বায়োমেট্রিকসহ অত্যাধুনিক মেশিন।
শুধু চক্ষু হাসপাতালগুলো নয়, চট্টগ্রামের শহরে বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতিটি পর্যায়ে অতি মুনাফামুখীতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। প্রাইভেট রোগী দেখা দেখা হতে শুরু করে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নেওয়া, ল্যাব টেস্ট, অ্যাম্বুলেন্স সেবা ও ঔষুধ ক্রয়ের প্রতিটি ক্ষেত্রে রোগী ও রোগীর স্বজনদের হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার হতে হয়। অসুস্থ ও জটিল রোগী এবং মৃত লাশ পরিবহনের ক্ষেত্রে অ্যাম্বুলেন্স মালিক ও চালকের কাছে জিম্মি হযে পড়েন রোগীর স্বজনরা। অনেকটা নিরূপায় হয়ে অ্যাম্বুলেন্স সেবা গ্রহণ করতে হয়ে। চট্টগ্রাম মহানগর প্রায় ১০০ অধিক অ্যাম্বুলেন্স আছে যার অধিকাংশ চড়া মূল্যে লাশ ও রোগী পরিবহন করে থাকে। চলতি পরিবহন ভাড়া যেখানে ২০০০ টাকা, সেখানে একটি অ্যাম্বুলেন্স দুই-পাঁচ গুণ ভাড়া নিয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মেডিকেলের ডাক্তার তৌফিকুল মজিদ বলেন, কিছুদিন আগে খুব জরুরি প্রয়োজনে এক অ্যাম্বুলেন্স চালককে আগ্রাবাদে পৌঁছে দিতে বলি। আর চালক ভাড়া চাইল ১২০০০ টাকা। এ ক্ষেত্রে রোগী কি অবস্থা হয় ভেবে দেখেন।
চট্টগ্রাম মহানগরে জুড়ে ব্যাঙের ছাতার মত গড়ে ওঠা অসংখ্য মানহীন ও অনুমোদনহীন রোগ নির্ণয়কেন্দ্রগুলোর স্বাস্থ্যসেবার নামে বৃদ্ধি করছে জনদুর্ভোগ। এক ধরণের অসাধু চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্মচারীদের যোগসাজশে আর মুনাফালোভী কিছু ব্যবসায়ীদের কারণে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নামে চলছে রমরমা ব্যবসা ও অনিয়ম। তাছাড়া তাদের দালালের খপ্পরে পড়ে প্রতিনিয়ত প্রতারণার শিকার হচ্ছে সহজ-সরল-সাধারণ-দরিদ্র মানুষগুলো। এসব সেন্টারের একদিকে যেমন নেই সংশ্লিষ্ট দফতরের কোন অনুমোদন, নিজস্ব ভবন, একইভাবে নেই পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি এবং প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত দক্ষ জনবল। নেই তদারকি সংস্থাগুলোর কার্যক্রম।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রামে চিকিৎসা সেবার নাজুক পরিস্থিতিকে পুঁজিকে করে একটি অসাধু মহল নগরীর যত্রতত্র গড়ে তুলেছে অসংখ্য ডায়াগনস্টিক সেন্টার। ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার স্থাপনের মাধ্যমে এই ব্যবসায় বিনিয়োগ দিনে দিনে বেড়েছে। অথচ বাড়েনি সেবার মান ও রোগ নির্ণয়ের সক্ষমতা। চট্টগ্রাম মহানগর ও চট্টগ্রাম জেলায় প্রায় এক হাজারও অধিক ডায়াগনস্টিক সেন্টার আছে। কিন্তু চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা যায় পুরো জেলায় ৩৪৩টি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনুমোদন আছে। আর বাকিগুলো অবৈধ ও অনুমোদনহীনভাবে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। যত্রত্রত গড়ে ওঠা অধিকাংশ ডায়াগনস্টিক সেন্টার রমরমা বাণিজ্য চালাছে অসাধু ডাক্তারদের লোভনীয় কমিশন প্রদানের মাধ্যমে। এ কমিশনের হার ২০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে। ডাক্তার ও দালালদের কমিশন নিশ্চিত করা হলেও নিশ্চিত করা হয় না রোগীদের নির্ভুল রিপোর্ট। কারণ, সার্বক্ষণিক ডাক্তার ও টেকনোশিয়ান না থাকা, ডায়াগনস্টিক সেন্টার বৃদ্ধি, অল্প সময়ে অধিক রিপোর্ট ও দ্রুত প্রদানের চেষ্টা, নমুনা সংগ্রহের আইডি নম্বর প্রদানের অসতর্কতা, প্যাথলিজিস্টের খামখেয়ালিপনাসহ বাহিরে থেকে পরীক্ষা রিপোর্ট সংগ্রহ করে দেয়া। এসব কারণে রোগীদের দেয়া হচ্ছে ভুল রিপোর্ট। ফলে জনদুর্ভোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে যাদের সামর্থ্য আছে তারা দেশীয় চিকিৎসা সেবায় আস্থা হারিয়ে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছেন। আর যাদের সামর্থ্য নেই তারা এসব অনিয়মের কাছে জিম্মি হয়ে হয়রানি শিকার হচ্ছেন।
সিভিল সার্জন, বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিক ও সেবাপ্রত্যাশীদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, অধিকাংশ ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো প্রতিনিয়ত মেডিক্যাল প্র্যাকটিস অ্যাক্ট ১৯৮৩ অধ্যাদেশকে ভঙ্গ করছে। অনুমোদনের প্রাপ্তির আগে ডায়াগনস্টিক সেন্টার স্থাপন ও পরিচালনা, প্রতি বছর নবায়ন না করা, সার্বক্ষণিক ডাক্তার ও টেকনোশিয়ান না থাকা, ডায়াগনস্টিক সেন্টার বৃদ্ধি, অল্প সময়ে অধিক রিপোর্ট প্রদানের চেষ্টা, নমুনা সংগ্রহের আইডি নম্বর প্রদানের অসতর্কতা, প্যাথলিজিস্টের খামখেয়ালিপনা ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে ভুল রিপোর্ট দেয়া হচ্ছে। এসব ত্রুটিপূর্ণ রিপোর্ট নিয়ে প্রতিনিয়ত বিপাকে পড়তে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। সবচেয়ে আতংকের বিষয় হলো চট্টগ্রামের অসংখ্য ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নির্দিষ্ট রিপোর্ট প্যাডে প্যাথলজিস্টের স্বাক্ষর আগে থেকেই দেয়া থাকে। পরীক্ষা করে টেকনিশিয়ান রিপোর্ট লিখে দিচ্ছে ইচ্ছামত। আছে অভিযোগ পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত পরিবেশের অভাব, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাব, প্রশিক্ষিত ও দক্ষ টেকনোশিয়ান ও প্যাথলজিস্টের অবাব। বাদ নেই স্বনামধন্য বেসরকারি হাসপাতাল ও রোগ নির্ণয়কেন্দ্রগুলোর রিপোর্ট। হাতেগোনা সাত-আটটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্যদের সেবার মান ও সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে যায় সাধারণ মানুষের কাছে।
নগরের পপুলার ডায়াগনস্টিকে আসা নাজনীন নাহার বলেন, ‘টাকা দিয়েও প্রতিনিয়ত প্রতারণার শিকার হচ্ছি। যাদের আমরা বিশ্বাস করি তারাই আমাদের প্রতিনিয়ত ঠকাচ্ছে।’ অপরদিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সামনে মেডি এসকেনে গিয়ে দেখা যায়, প্যাথলজিক্যাল, এক্স-রে, আলট্রাসনোগ্রাফি ইত্যাদি করা হয়। কিন্তু অফিস ব্যবস্থাপক কিশোর কুমার বলেন, ‘আমরা আলট্রালসনোগ্রাফি ছাড়া আর কোনো টেস্ট করি না।’ তা হলে এসব লিখলেন কেন জানতে চাইলে, তিনি বলেন, ‘আগে থেকে লিখা ছিল। এ আর কি।’
এ প্রসঙ্গে বলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা অনুষদের ডীন ডাক্তার সেলিম মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, ‘ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ভুল রিপোর্ট এবং এর পাশাপাশি এক শ্রেণীর চিকিৎসকের কথিত কমিশন বাণিজ্যের কারণে কেবল রোগীরাই কেবল প্রতারণার শিকার হচ্ছে না, দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাও দুর্নামের শিকার হচ্ছে। কিন্তু এসব অভিযোগের কার্যকর কোন প্রতিকারের আলামতও লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। পরিণামে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি মানুষ আস্থা হারাতে বাধ্য হচ্ছে। কিছু সংখ্যক চিকিৎসকের এ প্রতারণার কারণে সৎ ও নিষ্ঠাবান চিকিৎসকদের বেকায়দায় পড়তে হয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘কেবলমাত্র ভুল রিপোর্ট দেয়া হচ্ছে তা নয়, কারণে-অকারণে একাধিক টেস্ট করিয়ে নিরীহ রোগীদের সর্বশান্তও করে ছাড়ছে প্রতারক চক্ররা’।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম জেলার সিভিল সার্জন ডা. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, ‘একথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে নগরীতের ভুয়া ডায়াগনস্টিক সেন্টার নেই। মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে চিকিৎসক নামের নামের এক ধরণের অতি অর্থলোভী কিছু মানুষ এ ঘৃণ্য মানবতাবিরোধী কাজের সাথে জড়িত। তবে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে এসব অনুমোদনহীন ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হবে।’
নগরের অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রতিনিয়ত সেবার নামে চলছে বাণিজ্য। এসব হাসপাতালগুলোতে নেই দৃশ্যমান সেবার মূল্য তালিকা। এক এক রোগীর সেবার বিল এক এক রকম। এক পরিসংখ্যানের দেখা যায় সরকারি হাসপাতালগুলোতে শয্যা আছে ১৪০০ মত। অপর দিকে অনুমোদনকৃত বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে শয্যা আছে ৪৫০০ও অধিক। আর এর বাহিরে অনুমোদনবিহীন হাসপাতালগুলোতে আছে আরো ৫০০ অধিক শয্যা আছে। এসব বেসরকারি শয্যাগুলোতে মাসে আয় হয় দুই থেকে তিন কোটি টাকা। আছে অপ্রয়োজনে আইসিইউ, এনআইসিইউ, সিসিইউ রোগী ভর্তির বাণিজ্যের অভিযোগ। পাশাপাশি ডাক্তার-নার্সদের অশোভন আচরণও। অসংখ্য ভুল চিকিৎসার অভিযোগও। করা হয় না সঠিকভাবে হাসপাতাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। সিভিল সার্জন ডা. মো. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, মহানগরীতে প্রায় অর্ধশত লাইসেন্সবিহীন হাসপাতাল আছে। অবৈধ এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বেসরকারী হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধে নিয়ম নীতি ভঙ্গের নানান অভিযোগ। ইমারত নির্মাণবিধি লঙ্ঘন করে চট্টগ্রামের অভিজাত আবাসিক এলাকাগুলোয় নিয়মিত হারে বাড়ছে বাণিজ্যিক বেসরকারি হাসপাতাল, ল্যাব, ডক্টরস চেম্বার অন্যতম। চট্টগ্রামের এক সময়ের অভিজাত আবাসিক এলাকা কাতালগঞ্জ। এখানে সরেজমিনে দেখা গেছে, এলাকার বেশিভাগ এলাকা জুড়ে বেসরকারি হাসপাতাল, ল্যাব, ডক্টরস চেম্বার প্রভৃতি। জানা গেছে, কাতালগঞ্জ আবাসিক প্রকল্প সিডিএ বাস্তবায়িত প্রথম আবাসিক প্রকল্প। এ প্রকল্পে প্লটের সংখ্যা ৫৮টি। সম্পূর্ণ আবাসিক ভবনের অনুমোদন নিলেও এখানে অবৈধভাবে ২৩টি হাসপাতাল, ল্যাব, ডক্টরস চেম্বার সহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চলছে ২৫-৩০টি ভবনে।
আবাসন হিসেবে গড়ে ওঠা সিডিএ’র প্রকল্পগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রকল্প ‘চান্দগাঁও আবাসিক প্রকল্প’। এ আবাসিক এলাকার ৭৫৯টি ভবনের মধ্যে শতাধিক ভবন এখন বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। সিডিএ’র সর্বশেষ (আগস্ট ২০১৫) জরিপ অনুযায়ী, চান্দগাঁও আবাসিক এলাকায় বর্তমানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা) ও হাসপাতাল-ক্লিনিকের সংখ্যা অর্ধশতাধিক। চান্দগাঁও আবাসিক এলাকায় পরিচালিত বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন স্কুল, এনজিও, ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান, ছাত্রাবাসসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান।
একইভাবে সিডিএ, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও দি চিটাগং কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটির উদ্যোগে গড়ে ওঠা নগরীর ২৮ আবাসিক এলাকায় অবৈধভাবে প্রচুর প্রাইভেট ক্লিনিক-হাসপাতালসহ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠায় উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ।
সিডিএর চেয়ারম্যান আবদুস সালাম বলেন, ‘সিডিএর অনুমোদন ছাড়া আবাসিক এলাকায় সরকারি-বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানই গড়ে তোলার বিধান নেই। এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। শিগগিরই এগুলোর বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ নেয়া হবে। তবে এ ব্যাপারে আবাসিক এলাকার বাড়ির মালিক ও সমিতিগুলো আগে থেকে সচেতন হলে বিষয়টি এত বড় আকার ধারণ করত না।’
চট্টগ্রাম সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের তথ্যমতে, বিনামূল্যে বিতরণের জন্য চট্টগ্রামের ১৪ উপজেলার হাসপাতালে প্রতি মাসে শতাধিক পদের প্রায় ২০ কোটি টাকার ওষুধ সরবরাহ করা হয়। প্রতি উপজেলায় একটি করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ৭৩টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র, পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন ১৩৩টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণকেন্দ্র, সিভিল সার্জনের অধীন নগরে নয়টি আরবান ডিসপেনসারি আছে। তবে রোগীদের অভিযোগ, সরকারিভাবে শতাধিক ওষুধ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সরবরাহ করা হলেও হাতেগোনা কয়েকটি ওষুধ পায় তারা। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজসহ বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে ঢাকার তেজগাঁও কেন্দ্রীয় ওষুধাগার থেকে ওষুধ সরবরাহ করে।
সরকারি হাসপাতালগুলোর সেবাগ্রহীতাদের অভিযোগ, সরকারি হাসপাতালগুলোয় প্যারাসিটামল জাতীয় ছাড়া দামি কোনো ওষুধ দেয়া হয় না। চিকিৎসকদের তালিকা অনুযায়ী, বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে হয় তাদের। জেলা ও নগরের সব হাসপাতালেই একই অবস্থা। অথচ ফার্মেসিতে কিনতে গেলেই অনেক সময় লাল-সবুজের সরকারি ওষুধ গচিয়ে দেয়া হয়। হাসপাতালগুলোর একশ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী, নার্স, তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা বিনামূল্যের ওষুধ ফার্মেসিতে সরবরাহ করেন।
এ বিষয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ রুহুল আমীন বলেন, ‘চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের আশপাশে কয়েকটি ফার্মেসিতে সরকারি ওষুধ বিক্রি হচ্ছে। এর বাইরে নগরের যে এলাকায় অভিযান চালানো হচ্ছে, সেখানেই মিলছে সরকারি ওষুধ। প্রায় ফার্মেসিতেই সরকারি ওষুধ পাওয়া যাওয়ায় বিষয়টি নিয়ে আমরা শঙ্কিত।’
কোনো কোম্পানির নাম না থাকলেও অ্যারোক্সিল ফর ম্যান নামক ভিটামিন ১ হাজার ৫৫০ টাকা, ওলিগোকেয়ার ১ হাজার ১৯০ টাকা, ইপাসেট ১ হাজার ১০০ টাকা, ইউনিকেয়ার ৯৯০ টাকা, বেল শার্ক ১ হাজার ৩৯০, সি-জয়েন্ট ১ হাজার ২০০, ক্রক্সি ফর ম্যান ১ হাজার ৫৫০, ফিলগ্রাস্ট ২ হাজার ৩৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ডাক্তারদের মোটা অঙ্কের উপঢৌকন দিয়েই প্রেসক্রিপশনে লেখানো হচ্ছে এসব ভিটামিন।
জানা গেছে, নামিদামি ডাক্তাররা এসব বেনামি কোম্পানির বিভিন্ন ওষুধের নাম প্রেসক্রিপশনে লিখছেন। যার প্রমাণ পাওয়া গেছে বেনামি কোম্পানির ওষুধের তালিকার সঙ্গে রোগীদের দেওয়া ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশনে। চমেক হাসপাতালের নিউরোলজি বিভাগের এমডি ডা. তৌহিদুর রহমান গত ২৩ নভেম্বর তারিখে ওসমান গনি নামক ৩৫ বছর বয়সী এক রোগীকে ভিসমিট এ টু জেড ও হল ডি-সিয়াম নামক দুটি বেনামি কোম্পানির ভিটামিন দেন। মেডিসিন, হাঁপানি ও অ্যালার্জি বিশেষজ্ঞ ডা. কিউ এম অহিদুল আলম গত ১ নভেম্বর ১১ বছর বয়সী মাইসুর রহমানকে দেন লাইফ-থ্রি নামক ভিটামিন। মেডিসিন ও নিউরোমেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. মসিহুজ্জামান (আলফা) করুণা নামক এক রোগীকে বোন্স নামক একটি ভিটামিন দেন। বক্ষব্যাধি-অ্যাজমা বিশেষজ্ঞ ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ ৯ সেপ্টেম্বর আনোয়ারা বেগমকে ট্যাবলেট পিরফিনিক্স নামক একটি ভিটামিন দেন। চমেকের ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. শেখ আহমেদ ৫৫ বছর বয়সী মো. নুরুল আমিনকে ২৯ সেপ্টেম্বর ক্যাপসুল ডি-সিয়াম নামক একটি ওষুধ দেন। চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন অফিসার (চক্ষু) ডা. প্রণব প্রসাদ দাশ ২৮ সেপ্টেম্বর ৭০ বছর বয়স্ক আজিজুল হককে লাইফ-৩ নামক একটি বেনামি কোম্পানির ভিটামিন লিখে দেন তার প্রেসক্রিপশনে। এক সপ্তাহ নগরীর হাজারী গলির ওষুধের দোকানে আসা প্রেসক্রিপশন সংগ্রহ করে দেখা যায় ৮০ শতাংশ প্রেসক্রিপশনেই আছে নামহীন কোম্পানির মানহীন ভিটামিন। ব্যবস্থাপত্রে ফুড সাপ্লিমেন্ট না লেখার জন্য গত বছরের অক্টোবরে চিকিৎসকদের বিভিন্ন সংগঠনের কাছে চিঠি দেয় ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। লক্ষ্য ছিল ভেজাল ও নিম্নমানের এসব ফুড সাপ্লিমেন্ট বিক্রি বন্ধ করা। কিন্তু এর পরও রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন ওষুধের দোকানে বিক্রি হচ্ছে ফুড সাপ্লিমেন্ট। চিকিৎসকরাও এখনো ব্যবস্থাপত্রে এসব লিখে যাচ্ছেন। এমনকি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা অনেক রোগীকে ওষুধের পাশাপাশি ফুড সাপ্লিমেন্ট দেয়া হচ্ছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, একটি কৌটা লিখে চিকিৎসক ২০০-৩০০ টাকা এবং দোকানিরাও প্রায় সমপরিমাণ টাকা পাচ্ছেন। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন রোগীরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিক্রয় নীতিমালা না থাকলেও চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রে ঠিকই জায়গা করে নিচ্ছে নিউট্রিশনাল সাপ্লিমেন্ট বা ফুড সাপ্লিমেন্ট। যদিও এর বেশির ভাগই নিম্নমানের। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে সাধারণ মানুষ। আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে হৃদরোগ, লিভার, কিডনিজনিত ও ক্যান্সারের মতো রোগের। যদিও মাছ, মাংস, ডিম, শাকসবজি ও ফলমূলসহ পুষ্টিকর খাবার খেলেই এসব ফুড সাপ্লিমেন্টের প্রয়োজন পড়ে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধবিদ্যা অনুষদের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক এ প্রসঙ্গে বলেন, মানুষের শরীরে কোনো ভিটামিনের অভাব দেখা দিলে সেটি গ্রহণ করলেই যথেষ্ট। কিন্তু বাজারে যে প্রচলিত ফুড সাপ্লিমেন্ট বিক্রি হচ্ছে, তা মানুষের আদৌ প্রয়োজন নেই। গরিব রোগীরা এতে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন।
সাইফ উল আলম : নিবার্হী পরিচালক, মিডিয়া একাডেমি অব চিটাগাং (ম্যাক)। saiful_cu_eco@yahoo.com
