স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও আমাদের উচ্চ শিক্ষার ভবিষ্যৎ

0
800

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও আমাদের উচ্চ শিক্ষার ভবিষ্যৎপ্রফেসর

সরওয়ার জাহান

স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করতে যাচ্ছে বাংলাদশ। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল মধ্যম আয়ের দেশ । মর্যাদা সম্পন্ন উন্নত দেশ গড়ার লক্ষ্যে দিন দিন বাড়ছে শিক্ষার হার। স্বাধীনতার পর দুইটি প্রজন্ম অবসরে গেছে। কিন্তু কতজন কর্মমুখি বা নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছেন এবং জ্ঞানে-বিজ্ঞানে নতুন তত্ত্ব ও তথ্য দিয়ে অবদান রেখেছেন! এই বছর ইউএনডিপির বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার সর্ব নিম্ন অবস্থানে বাংলাদেশ। গবেষণা ও উদ্ভাবনে ১৬.৪ স্কোর নিয়ে ১৩৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১২তম। আর উচ্চ শিক্ষায় ২৪.১ স্কোর নিয়ে বিশ্বের মধ্যে ১২৯।

শিক্ষিত হতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার দরকার হয়না, আক্ষরিক জ্ঞান থাকলেই শিক্ষিত। যারা আরও শিক্ষিত হতে চান তারা উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাও নিতে পারেন। আর শিক্ষালব্ধ অভিজ্ঞতার প্রায়োগিক দিক হলো জ্ঞান। যিনি ভালো-মন্দের বিচার করে সর্বকল্যাণে কাজ করেন তিনিই জ্ঞানী। একজন জ্ঞানী ব্যক্তি তাঁর নিরলস চেষ্টা ও আগ্রহ দ্বারা যে সৃজনশীল অনুভূতি ও প্রায়োগিক প্রজ্ঞা অর্জন করেন সেটাই সুশিক্ষা। বিশ্ববিদ্যালয়ে এই জ্ঞানীদেরকেই স্বীকৃতি সনদ দেওয়ার কথা। অথচ আমরা সবাইকে জ্ঞানী বলে সনদ দিচ্ছি। ফলে সমাজে সনদধারী লোকে ভরে উঠেছে। অথচ আমাদের জানা উচিৎ বিশ্ববিদ্যালয় সবার জন্য নয়।

অনেকের ধারণা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাই একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে দক্ষতা ও উচ্চতর যোগ্যতা অর্জন করার একমাত্র পথ। তাই উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্তির পর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অনেকের কাছে সঠিক গন্তব্য মনে হয়। সমাজে একটি ধারণা আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি “শিক্ষার্থীকে” সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করবে। অনেকে মনে করেন ন্যূনতম স্নাতক ডিগ্রি না থাকলে সমাজে অবমূল্যায়িত হবে। এই ধরনের মানসিকতার কারণে শিক্ষার চেয়ে সনদ বড় হয়ে দেখা দেয় । তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণগত মান নিম্নমুখি, হারিয়ে যাচ্ছে মূল্যবোধ ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি শ্রম-বাজারের সমস্যার সমাধান করতে পারে না, ডিগ্রি নিয়ে রাতারাতি বড় কিছু হওয়া যায় না বরং তৈরি হচ্ছে শিক্ষিত বেকার। সমাজ উন্নয়নের জন্য যোগ্য আইনজ্ঞ, চিকিৎসক, প্রশাসক, প্রযুক্তিবিদ তৈরিতে রাষ্ট্র যে পরিমাণ টাকা খরচ করে সে পরিমাণ কী রা্‌ষ্ট্র বা সমাজ পায়! বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষার্থীর ৪ বছরের পড়াশুনা অত্যন্ত ব্যয়বহুল । রাষ্ট্র এই খরচ করে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে জনগণের করের টাকায় এবং বিভিন্ন ধরনের অনুদানের মাধ্যমে। আর বেসরকারির ক্ষেত্রে উদ্যোক্তা ও শিক্ষার্থীদের পিতামাতার সঞ্চিত অর্থ যা উচ্চ শিক্ষায় ব্যয় হয় ।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের জীবনে আগ্রহ এবং দক্ষতার সুযোগ সরবরাহ করে। শিক্ষার্থীরাও তাদের মন-মানসিকতা এবং দক্ষতার সাথে তাল মিলিয়ে নিজেকে উচ্চ শিক্ষায় তৈরিতে প্রস্তুত করবে এটাই প্রত্যাশা। তবে সবার জন্য একই মাপকাঠি নাও হতে পারে। ক্যারিয়ারে আরবী শিক্ষা, ডিপ্লোমা শিক্ষা বা কারিগরি শিক্ষাকে ছোট করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় সবার পছন্দ বা ইচ্ছার জন্য নয় বা প্রত্যেকের পেশা পরিকল্পনার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গও নয়। তাই বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা শুধু সম্ভ্রান্ত পরিবারের জন্য তাও নয়। প্রত্যেকেরই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ থাকা উচিত যদিও দুঃখজনক অনেকে সুযোগ পায় না। বিশেষায়িত শিক্ষা নিয়ে যত বেকার দেখা যায় তার চেয়ে অনেক বেশি বেকার সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিতরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদানে মেধা সম্পন্ন শিক্ষক যেমন জরুরি তেমনি বুদ্ধিমান শিক্ষার্থীও প্রয়োজন। যে মেধাবী শিক্ষার্থী আইন, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি, প্রশাসন বিষয়ে পড়ে সমাজের জন্য ভাল কিছু দেওয়ার কথা ছিল কিন্তু প্রচলিত শিক্ষার কারণে তা হচ্ছে না। ফলে দায়সারা সনদ অর্জনই লক্ষ্য হয়ে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয় কাউকেও চৌকস বানায় না, কারণ সমাজে প্রচুর জ্ঞানী, চৌকস বা সফল ব্যক্তি আছেন যাঁরা কখনও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হননি বা ডিগ্রি নেন নি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিধ কারণে কিছু শিক্ষার্থী অমনোযোগী অনিয়মিত হয়ে যায়। তারা পরীক্ষার দু’সপ্তাহ আগে সিরিয়াস হতে দেখা যায় বা পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন খুঁজে। একজন শিক্ষার্থীর উচিৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার আগ্রহ না থাকলে, সে যে কাজে আনন্দ এবং স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে তাতে মনোনিবেশ করা। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অমনোযোগী শিক্ষার্থীর জন্য পরামর্শ বা সহযোগিতার কোন ব্যবস্থাই নেই। অবহেলিত, অকৃতকার্য বা বিপথগামী শিক্ষার্থীদেরকে শিক্ষাচর্চায় ফিরিয়ে আনার কোন উদ্যোগ দেশে দেখা যায় না এবং এর চিন্তাও নাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বা রাষ্ট্রের। অথচ প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদেরকে শিক্ষাচর্চায় ফিরিয়ে আনার বিশেষ বিভাগ থাকা খুবই জরুরি। বেসরকারি কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয় স্বল্প পরিসরে মনস্তাত্ত্বিক পরামর্শের ব্যবস্থা রেখেছে। শিক্ষার্থীদের অনাগ্রহতা থেকেই তৈরি হয় বিক্ষিপ্ত আচরণ। যার ফলে তৈরি হয় অপরিপক্ষ সমাজ। শিক্ষার্থীর অমনোযোগী হওয়ার জন্য অনঅভিজ্ঞ শিক্ষক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি অন্যতম কারণ। অব্যবস্থপনা, অজ্ঞতা, অদূরদর্শিতা, স্বজনপ্রীতি এবং রাজনৈতিক প্রভাব দেখেই এই শিক্ষার্থীরা বড় হচ্ছে। তাই সঠিক নেতৃত্বের অভাবে আমাদের শিক্ষার্থীরা শেখার চেয়ে সনদের প্রতিই আগ্রহ থাকে বেশি।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের অনাগ্রহতার দায় এড়াতে পারে না। যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়ানো দরকার, শিক্ষার্থীদেরকে ব্যস্ত রেখে সময় দেওয়া প্রয়োজন, এসব না থাকায় শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীরা আকৃষ্ট হয় না।  শিক্ষকরা ভুলে যান, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অনেক চতুর । শিক্ষকরা পড়ান কিন্তু পড়তে চান না। উন্নত শিক্ষা পদ্ধতি ও কৌশলের জন্য শিক্ষকদেরও মাঝে মাঝে শিক্ষার্থী হওয়া প্রয়োজন । তাঁরা বিদেশে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিতে পছন্দ করেন কিন্তু দেশের প্রশিক্ষণ তাঁদের মনপুত হয় না । বিদেশি প্রশিক্ষক আসলেও অনেকেই আগ্রহ দেখান না । প্রশ্ন তুলেন প্রশিক্ষকের যোগ্যতা নিয়ে। শিক্ষকরা পেশাজীবী শিল্প প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পর্ক রাখেন না। গতানুগতিকভাবে যা পড়ে সনদ নিয়েছেন সেই পাঠ্য পড়িয়ে দায়িত্ব সারেন। সঠিক মানের গবেষণা দেখা যায় না তবে গবেষণার নামে রচনা পাওয়া যায়। এই দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রায় দ্বিতীয় শ্রেণির সম্মানিত ব্যক্তি ছাড়া আর কিছুই নয় । বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা শুধু মাসিক পারিশ্রমিক আর সুবিধার জন্যই ব্যস্ত থাকেন। সমাজের যে কোন দুর্যোগ, সমস্যা সমাধানে তাদেঁর ভূমিকা থাকার কথা থাকলেও তা দেখা যায় না। রাজনৈতিক দলীয় শিক্ষকরা অবশ্য ব্যস্ত থাকেন বক্তৃতা-বিবৃতিতে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তার প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো থাকার পরও বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত । নীতি-নির্ধারকদের আদেশ-উপদেশও মানে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের মূল চেতনা থেকে অনেক দূরে।

শিক্ষার্থীদের উচ্ছৃঙ্খল-উদ্দেশ্যহীন অবস্থান থেকে ফিরিয়ে এনে শ্রেণি শিক্ষায় অভ্যস্ত করতে কে এগিয়ে আসবে? শিক্ষাঙ্গণে দুর্বল ব্যবস্থাপনা, অস্থিতিশীল পরিবেশ বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কেউ কামনা করে না, একারণেই উচ্চ শিক্ষার পরিবেশ অনাকাঙ্ক্ষিতভাবেই কলঙ্কিত হচ্ছে। উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় সন্তানরা গড়ে উঠছে অপরিকল্পিতভাবে। জড়িয়ে পড়ছে লোভ-বিলাসী নিয়ন্ত্রণহীন অপকর্মে। সর্ব স্তরের শিক্ষায় যথাযত তদারকি যেমন দরকার তেমনি শিক্ষা গ্রহন করে কোথায় কাজে লাগাতে পারবে তার একটা স্বচ্ছ ধারনা থাকা দরকার ।

সফলতার জন্য উচ্চতর ডিগ্রি প্রয়োজন নেই। তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলাদেশসহ পৃথিবী অনেকদূর এগিয়েছে। তথ্য প্রযুক্তির সুবাধে বর্তমান বিশ্বের তথ্যভাণ্ডার প্রবেশ করে যেকেউ যে কোন বিষয়ে পড়ার পাশাপাশি অনলাইনে কোর্সে অংশগ্রহণ করতে পারে বা তথ্যের অনুসন্ধান করতে পারে। ফলে কর্মমুখি শিক্ষার জন্য একজন শিক্ষার্থী বছরে কয়েক লক্ষ টাকা খরচ না করেও প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। অবশ্য এই ধরনের শিক্ষার মাধ্যমে কোন প্রচলিত ডিগ্রি পাওয়া যাবে না, তবে কেউ যদি কোনও নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে কাজ করতে আগ্রহী হয় তবে বিশ্ববিদ্যালয় না গিয়েও সে ঐ বিষয়টির উপর প্রশিক্ষণ নিয়ে সফল হতে পারেন। সমাজে অনেকেই আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ছাড়াও প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। ডিগ্রি কাউকে কাজের জগতে সফলতার নিশ্চিয়তা দেয় না। সুনির্দিষ্ট গন্তব্যে যাওয়ার জন্য দৃঢ় সংকল্প, পরিশ্রমই এনে দিতে পারে সফলতা। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে যুবসমাজকে মানব সম্পদে পরিণত করতে দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা অপরিহার্য । তবেই পছন্দ অনুযায়ী সে তার লক্ষ্যে পোঁছতে পারবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবে তারা যারা বিষয়ভিত্তিক গবেষণা করে জ্ঞানে বিজ্ঞানে নতুন নতুন তত্ত্ব ও তথ্য আবিষ্কার করে সমাজকে বিকশিত করবে। এভাবেই বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান অন্বেষণ, জ্ঞানী তৈরি ও জ্ঞান বিতরণ করে টেকসই মানবসম্পদে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। তা না হলে উচ্চ শিক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে সম্ভাবনার চেয়ে শঙ্কায় বেশি থাকবে।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, সাদার্ন ইউনিভার্সিটি এবং টেকসই উন্নয়নকর্মী