ইতিহাসের স্বর্ণালী পাতায় জনপ্রিয় গণসঙ্গীত শিল্পী ফকির আলমগীর

0
359

ইতিহাসের স্বর্ণালী পাতায়  জনপ্রিয় গণসঙ্গীত শিল্পী ফকির আলমগীর

দখিনা ডেস্ক : ফকির আলমগীর (২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫০ – ২৩ জুলাই ২০২১) ছিলেন বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী। গণসঙ্গীত ও দেশীয় পপ সঙ্গীতে তার ব্যাপক অবদান রয়েছে। তিনি ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৯৯ সালে তিনি বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক একুশে পদকে ভূষিত হন।

ফকির আলমগীর ১৯৫০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুরের ভাঙ্গা থানার কালামৃধা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মোঃ হাচেন উদ্দিন ফকির, মা বেগম হাবিবুন্নেছা। ফকির আলমগীর কালামৃধা গোবিন্দ হাই স্কুল থেকে ১৯৬৬ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন।

জগন্নাথ কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রী নিয়ে পরবর্তী পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় এমএ পাস করেন। ১৯৬৬ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য হিসেবে ছাত্র রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠী ও গণশিল্পী গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে ষাটের দশকে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সঙ্গীত বলয়ে প্রবেশ করেন। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে শিল্পী একজন শব্দ সৈনিক হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দেন।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কোলকাতায় শরণার্থী শিল্পী গোষ্ঠীর হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তহবিল গঠনে কাজ করেন ফকির আলমগীর ।সেসময় নিজের কণ্ঠ নিয়ে কিছুটা হীনমন্যতা কাজ করতো ফকির আলমগীরের মধ্যে। “নিজেই বলতেন, গান গাবো কেমনে, গলা তো ফাটা বাঁশ।”

যার নিজের গলা নিয়ে সন্দেহ ছিল, সেই ছেলেই যে একদিন গান গেয়ে মানুষের মন জয় করবে, তা কে জানতো?  যৌবনে নিজের সঙ্গীত প্রতিভা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও পরবর্তীতে ফকির আলমগীর বিশ্বাস করতেন যে মানুষের সাথে সংযোগ তৈরির সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম সঙ্গীত।

তিনি সবসময় বলতেন গন সঙ্গীতের কোনো বিকল্প নেই। সঙ্গীত হতে পারে মানুষের কল্যাণে, এবং মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার একটা মাধ্যম। ফকির আলমগীর সারা জীবন নিজের এই মূল্যবোধে অটুট ছিলেন। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তার গানে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করে গেছেন, চেষ্টা করেছেন শ্রমজীবি, প্রান্তিক মানুষের গল্প তুলে ধরে তাদের জীবনের কল্যাণ সাধনের।

শ্রেণী সংগ্রামের গান, মানবমুক্তির গান, লড়াইয়ে শপথে উদ্দীপ্ত করার যে গান, সেটাই তিনি গাওয়ার চেষ্টা করেন । তাঁর মতে যতদিন শ্র্রেণী বৈষম্য থাকবে, শোষণ-বঞ্চনা থাকবে, অন্যায়-অবিচার থাকবে, ততদিন গণসঙ্গীতের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে না। সাধারণ মানুষের প্রতি ভালোবাসা থেকে ফকির আলমগীর মানুষের জীবনের ছোট ছোট ঘটনা নিয়ে গান তৈরি করেছেন, গান তৈরি করেছেন প্রান্তিক, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনের বাস্তবতা নিয়ে। সাধারণ মানুষকে নিয়ে গান লেখার পেছনে ফকির আলমগীরের কোনো স্বার্থ বা বৈষয়িক চিন্তা ছিল না। মানুষের জন্য ভালোবাসা থেকেই তিনি সাধারণ মানুষের জন্য গান তৈরি করেছেন। শুধু প্রান্তিক মানুষ বা শ্রমজীবি মানুষ নয়,  উচ্চবিত্ত বা নতুন প্রজন্মের অনেককেই  ফকির আলমগীরের ভক্ত ছিল।  সমসাময়িক নানা ঘটনা নিয়ে গান তৈরি করায় সাধারণ মানুষের কাছে ফকির আলমগীরের গ্রহণযোগ্যতা অন্য সঙ্গীতশিল্পীদের চেয়ে বেশি ছিল। “সাধারণ ঘটনা নিয়ে গান রচনা করে, মানুষকে পৌঁছে দেয়া, মানুষের মনের ভেতরে যাওয়া, এটাই  ছিল ফকির আলমগীর। যে কোনো ক্রান্তিকালেও ও দেখা যেত একটা গান রচনা করে সুর করে গাইতো। তার সমসাময়িক অন্য কোনো শিল্পী কিন্তু তা করেনি।” রানা প্লাজা দুর্ঘটনা, জগন্নাথ হল দুর্ঘটনা বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে সংঘটিত অপরাধ নিয়েও গান গেয়েছেন ফকির আলমগীর। আর এসব গানই তাকে নিয়ে গেছে মানুষের হৃদয়ের কাছে।দেশের ইতিহাসে অন্যতম সেরা এবং জনপ্রিয় গণসংগীতশিল্পী তিনি। গণসংগীত করে তার মতো বিস্তৃত পরিসরে খুব কম শিল্পীই পৌঁছতে পেরেছেন। তার গান গ্রাম-বাংলার প্রতিটি প্রান্তরে, প্রতিটি মানুষের কানে বেজেছে।

তার সবচেয়ে জনপ্রিয় উল্লেখযোগ্য গান ‘ও সখিনা, গেসস কিনা ভুইলা আমারে।’ এই সখিনা চরিত্রটিকে নিয়ে তার বেশ কয়েকটি গান রয়েছে।বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে ফকির আলমগীর জানিয়েছিলেন কেন এই সখিনা তার অনেক গানের প্রধান চরিত্র হিসেবে স্থান পেলো।”সখিনা একটি প্রতীকি সত্ত্বা। এই সখিনার মাধ্যমে  দেশের সব নির্যাতিত নারীকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন ।” “সখিনা তাঁর গানে এসেছে একজন নি:সঙ্গ নারী, নির্যাতিত নারী রূপে। সখিনা একজন মা, কারো আহ্লাদী বোন, কখনো এক সরল পল্লীবালার প্রতীক, আর কখনো প্রথম প্রেমের প্রতীক হিসেবে এসেছে এই গানে।”

বার্ধক্যে এসেও ফুরিয়ে যাননি ফকির আলমগীর। নিয়মিতই গান করে গেছেন। বছর খানেক আগেই তিনি গান করেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিহত হওয়া জর্জ ফ্লয়েডকে নিয়ে।

আলমগীর একজন লেখকও ছিলেন। তিনি ১৯৮৪ সালে তার প্রথম বই চেনা চায়না প্রকাশ করেন। তার পরবর্তী দু’টি বইয়ের নাম ছিল মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজয়ের গান এবং গণ সংগীতের অতীত ও বর্তমান। ২০১৩ সালে তিনি ৩টি বই প্রকাশ করেন – অমর কথাযারা আছে হৃদয় পটে এবং স্মৃতি আলাপনে মুক্তিযুদ্ধ। তিনি মোট নয়টি বই রচনা করেছেন। আবহমান বাংলার লোকসংগীত (২০২০)

দেশীয় সংগীতে ফকির আলমগীরের অবদান পরিমাপ করা অসম্ভব। তবে তার অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৯৯ সালেই তার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল সম্মানজনক একুশে পদক। এছাড়াও তিনি ভাসানী পদক সিকোয়েন্স সম্মাননা পদক সহ বিভিন্ন পুরস্কার ভূষিত হয়েছিলেন।
১৯৭৮ সালের ২৫ জানুয়ারি সুরাইয়া আলমগীরের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ফকির আলমগীর। বিয়ের পর যেখানে গেছেন, বেশির ভাগ অনুষ্ঠানেই স্ত্রীকে সঙ্গী হিসেবে পেয়েছেন ফকির আলমগীর।
বিপ্লবী সেই কণ্ঠ থেমে গেল ২৩ জুলাই ২০২১ খ্রিস্টাব্দে ৭১ বছর বয়সে । ১৪ জুলাই ২০২১ খ্রিস্টাব্দে তার করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পরে। শ্বাসকষ্ট বাড়তে থাকলে পরদিন তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ফুসফুস সংক্রমণের পাশাপাশি রক্তে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। ২৩ জুলাই রাত সাড়ে ৯টার দিকে তিনি হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেন। গণসংগীতের নায়ক হয়ে ফকির আলমগীর থেকে যাবেন দেশের ইতিহাসের স্বর্ণালী পাতায়।