তিউনিশিয়ায় বিক্ষোভ রাজনীতি সংকটে: প্রধানমন্ত্রী বরখাস্ত, কারফিউ জারি

0
322

তিউনিশিয়ায় বিক্ষোভ রাজনীতি সংকটে: প্রধানমন্ত্রী বরখাস্ত, কারফিউ জারি

এক দশক আগে আরব বসন্তের প্রভাবে আরব দেশগুলোর নাগরিকরা নিজেদের দেশের স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে এসেছিল। মরক্কো থেকে ইরাকজুড়ে স্বৈরশাসকবিরোধী এই বিক্ষোভের একমাত্র সফল পরিণতি ছিল উত্তর আফ্রিকার দেশ তিউনিসিয়ায়।

দেশে সহিংসতা ও অস্থিরতা ঠেকাতে রোববার দেশটিতে আকস্মিক সরকারবিরোধী বিক্ষোভের পর প্রেসিডেন্ট কায়েস সাইদ রাতে দুই বছর আগে নির্বাচিত পার্লামেন্ট স্থগিত, প্রধানমন্ত্রী হিশাম মাশিশিকে বরখাস্ত ও নিজের হাতে নির্বাহী ক্ষমতা নেয়ার ঘোষণা দিয়ে রাত্রিকালীন কারফিউ আদেশ জারি করেন।প্রেসিডেন্ট কায়েস সাঈদ সম্প্রতি দেশের প্রধানমন্ত্রী হিচেম মেচিচিকে বরখাস্ত ও জাতীয় সংসদ স্থগিত করেছেন। তিনি সরাসরি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী পদে নিজের পছন্দের লোক বসিয়ে দেশ শাসন করবেন। তার আকস্মিক কিছু সিদ্ধান্তের কারণে এই সহিংসতা ও অস্থিরতা সৃষ্টির আশংকা দেখা দিয়েছে।

গতকাল এক বক্তব্যে প্রেসিডেন্ট সাঈদ বলেন, “সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত আগামী এক মাস কারফিউ চলবে এবং জনগণকে তা মেনে চলতে হবে। তবে জরুরি চিকিৎসা বিভাগের কর্মীরা ও রাত্রিকালীন কর্মীরা কারফিউয়ের আওতায় পড়বেন না।”

কারফিউয়ের কারণে একসঙ্গে তিন ব্যক্তি রাস্তা কিংবা কোনো চত্বরে জড়ো হতে পারবেন না। শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর সঙ্গে এক বৈঠকে তিনি সবাইকে শান্ত থাকার ও রাজপথে আন্দোলনে না নামার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, তিউনিশিয়া কঠিন ও ঐতিহাসিক মূহুর্ত পার করছে।

প্রেসিডেন্ট সাঈদ বলেন, তিনি জাতীয় সংসদকে সময় দিয়ে প্রধানমন্ত্রী মেচিচিকে পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু সংসদ সদস্যরা বার বার তার এ পদক্ষেপে বাধা সৃষ্টি করেছেন। ফলে সংসদের ওপর তিনি ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছেন। প্রেসিডেন্টের ঘোষণার পর রাজধানী তিউনিসের সব সরকারি ভবনের পাহারায় সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়।

প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্ত তিউনিশিয়ার জনগণের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। অনেকে তার সিদ্ধান্তে খুশি হয়ে আনন্দ মিছিল করেছেন, দেশের সংকটাপন্ন অবস্থায় স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় এটি বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত। আবার অনেকে বিক্ষোভ-প্রতিবাদে নেমেছেন। বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আননাহদাসহ সব রাজনৈতিক দলই প্রেসিডেন্টের আদেশকে ‘সাংবিধানিক অভ্যুত্থান’ হিসেবে মন্তব্য করেছে।

তিউনিসিয়ার দীর্ঘকালীন স্বৈরশাসক জায়নুল আবেদিন বিন আলী ২০১১ সালে আরব বসন্তে বিক্ষোভে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বিক্ষোভকারীদের দাবি পূরণে পরবর্তী সরকারগুলো সংগ্রাম চালায়। দারিদ্র ও বেকারত্বে জর্জরিত এই বিক্ষোভকারীদের আকাঙ্ক্ষা ছিল দেশটিতে অবাধ নির্বাচন ও নাগরিক স্বাধীনতার প্রতিষ্ঠা।

বিপ্লবের পরেও তিউনিসিয়ায় বিশেষ করে যুব সমাজের মধ্যে বেকারত্বের সমস্যা অব্যাহত থাকে। পাশাপাশি উগ্রবাদী আইএসের কয়েক দফা হামলার ঘটনায় দেশটির আয়ের প্রধান উৎস পর্যটনেও ভাটা পড়ে। জীবন ধারণের মান ও সরকারি পরিষেবাও কমে আসে।

২০১৯ সালের অক্টোবরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর নিজেকে রাজনৈতিকবিরোধী হিসেবে প্রচারের প্রয়াস নেন কায়েস সাইদ। রাজনৈতিক দলবিহীন স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচিত সাবেক এই আইনের অধ্যাপক রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমনের প্রতিজ্ঞা করেন।

দায়িত্ব নেয়ার অল্প কয়েক মাস পরেই তিউনিসিয়ায় করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হয়। এক কোটি ২০ লাখ জনসংখ্যার দেশে ভাইরাস সংক্রমণে ১৭ হাজারের বেশি লোকের প্রাণহানি হয়। করোনা পরিস্থিতি বিপ্লবের পর খুঁড়িয়ে চলা দেশটির স্বাস্থ্যখাতের ওপর চাপ সৃষ্টি করে এবং অর্থনৈতিক সংকটকে আরো জটিল করে।

মে মাসে তিউনিসিয়া আন্তর্জাতিক তহবিল সংস্থা আইএমএফের সাথে আর্থিক সাহায্য প্যাকেজের বিষয়ে আলোচনা শুরু করে। যদি তা গ্রহণ করা হয়, তবে তা সংস্থাটি থেকে দেশটির জন্য চতুর্থবারের ঋণ নেয়া হবে।

তিউনিসিয়ার ঋণগ্রহণের বিনিময়ে আইএমএফের চাহিদা অনুযায়ী ইতোমধ্যেই দেশটিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে। একইসাথে করের হার বাড়ানো ও সরকারি ক্ষেত্রে চাকরির পরিমাণ কমানো হয়েছে। এর ফলে বিন আলীর সময় থেকেই নিষ্পেষিত জনগণ আরো ক্ষুব্ধ হয়।

এই বছর দেশের অর্থনীতি ছয় দশমিক পাঁচ ভাগ অবনতির আশঙ্কার মধ্যেই তিউনিসিয়ার জনগণের একাংশ রাজনৈতিক দলগুলোর বিপক্ষে বিক্ষোভ শুরু করে যাদের তারা শাসনের অযোগ্য ও দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে মনে করছে।

গত মে মাসে প্রোসিডেন্ট কায়েস সাইদের চিফ অব স্টাফ নাদিয়া আকাশার দফতর থেকে এক গোপন দলিল প্রকাশ হয়ে পড়ে। এই দলিলে দেশের বিপুল সমস্যা সমাধানে ‘সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করা হয়।

তিউনিসিয়ার পরিস্থিতিতে বিভিন্ন রাষ্ট্রই দেশটিতে গণতন্ত্রের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। যদিও বেশিরভাগই একে ‘অভ্যুত্থান’ হিসেবে উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকে।

তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তিউনিসিয়ার পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ জানায় এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশটিতে ‘গণতান্ত্রিক বৈধতা’ প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানায়।

জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তিউনিসিয়ায় সাংবিধানিক শৃঙ্খলা অনতিবিলম্বে প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানানো হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউজের মুখপাত্র এক সংবাদ সম্মেলনে তিউনিসিয়ার পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, তারা দেশটির পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন।’

কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, তারা প্রত্যাশা করছে তিউনিসিয়ার দলগুলো সংকট উত্তরণে সংলাপের পথে অগ্রসর হবে।

অবশ্য সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবে এর প্রতিক্রিয়া ছিল ভিন্নরূপ।আমিরাতের সংবাদমাধ্যম টোয়েন্টি ফোর মিডিয়ায় হেডলাইন করা হয়, ‘তিউনিসিয়াকে রক্ষায় সাহসী সিদ্ধান্ত’। অন্যদিকে অনেক সৌদি ও আমিরাতি একাউন্টে আননাহদার সাথে মুসলিম ব্রাদারহুডের সম্পর্ককে ইঙ্গিত করে হ্যাশট্যাগে ‘ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে তিউনিসিয়ার বিক্ষোভ’ যুক্ত পোস্টের সমাহার দেখা যায়।

সোমবার আলজাজিরার সাথে সাক্ষাতকারে সাবেক প্রেসিডেন্ট মুনসেফ মারজুকি উল্লেখ করেছিলেন, তার কোনো সন্দেহ নেই এই অভ্যুত্থানের পেছনে সংযুক্ত আরব আমিরাতের হাত রয়েছে।

এদিকে লিবিয়ার যুদ্ধবাজ নেতা খলিফা হাফতার তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট সাইদের পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন। সাথে সাথে তিনি জানিয়েছেন, তার বাহিনীকে তিনি আদেশ দিয়ে রেখেছেন তিউনিসিয়ায় বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশটিতে ঢুকে পড়া সন্ত্রাসবাদী যোদ্ধাদের প্রতিহত করতে প্রস্তুত থাকার।

সূত্র : মিডল ইস্ট আই আলজাজিরা