কেন বিলুপ্ত বাংলালায়ন !

0
214

কেন বিলুপ্ত বাংলালায়ন !

একসময়ের দাপুটে কোম্পানী বাংলালায়ন । অথচ এখন এর নামই শুনা যায় না। একবারে বিলুপ্তই হয়ে গেল কোম্পানীটি। কিন্তু কেন পতন হলো?

বাংলা লায়ন সানম্যান গ্রুপের একটি অংগ প্রতিষ্ঠান ছিল। গ্রুপ্টিতে ৩৩ টি গার্মেন্টস কারখানা, একটা বেভারেজ, একটা কার্টুন একটা টেক্সটাইল সহ বেশ কয়েকটি কারখ্যনার সমাহার হিসাবে নাম ছিল সানম্যান গ্রুপ। মালিক ছিলেন মেজর মান্নান। বর্তম্নের সতন্ত্র সাংসদ সদস্য লক্ষীপুর-৪ আসনের। তাঁর সব গুলা কোম্পানি গত দেড় দশক থেকে ক্রমান্বয়ে বন্ধ হয়ে যায় একই সাথে বাংলা লায়ন ও। শ্রমিক কর্চারিদের বেতন ভাতা এবং অনেক পাওনাদারদের দেনা শোধ করতে পারেন নাই। কেন এমন হলো এক সময়ের দাপুটে প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, মন্ত্রি, সবই ছিল। এরপরও চোখের পলকে উদাও । ঠিক কি কারণে জনপ্রিয় এই সার্ভিস প্রোভাইডারটি নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনায় ব্যর্থ হয়েছিলো?

২০০৮ সালে বাংলালায়ন ও কিউবি’র মতো প্রতিষ্ঠানের হাত ধরে বাংলাদেশে ওয়াইম্যাক্সের যাত্রা শুরু করে । নতুন এই প্রযুক্তি লঞ্চ হওয়ার খুব অল্পসময়েই বাংলাদেশে ইন্টারনেট সার্ফিংয়ের জন্য অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বাংলালায়ন এন্টারপ্রাইজ বা বিজনেস কাস্টমারদের পাশাপাশি, ইন্ডিভিজুয়াল কঞ্জ্যুমারদেরও সার্ভ করতো। বিভিন্ন তথ্যসূত্রে, ২০১৩ সালের জুন মাসে Banglalion’র ইউজার সংখ্যা ছিলো প্রায় ৪ লক্ষ। তবে, ২০২১ সালে বাংলালায়নের লাইসেন্স বাজেয়াপ্ত করা হলে, এই ওয়্যারলেস ইন্টারনেট কানেকশন প্রোভাইডারের কার্যক্রম অফিশিয়ালি পুরোপুরি ভাবে বন্ধ হয়ে যায়।

বাংলালায়ন কমিউনিকেশন্স লিমিটেড (বাংলালায়ন) হচ্ছে বাংলাদেশের একটি ৪জি ওয়্যারলেস ব্রডব্যান্ড অপারেটর যেটি বর্তমানে ওয়াইম্যাক্স প্রযুক্তি ব্যবহার করে, এটি বিটিআরসি থেকে দেশব্যাপী তারবিহীন ব্রডব্যান্ড সেবা প্রদানের অনুমতি গ্রহণ করেছে। বাংলালায়ন ৭টি বিভাগ ও দেশের ৩০টি প্রধান জেলায় তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে।

উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের ব্যবসা কিংবা উদ্যোগ শুরুর আগে কিংবা পরে অনেক বিষয় শেখাটা জরুরী। অন্যান্য সফল ও ব্যর্থ কোম্পানী থেকে শিক্ষা নিজেকে পরিপক্ক করে তোলে। পাশাপাশি জানা উচিৎ ব্যবসার কিছু সূত্র সম্পর্ক যা একজন উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ীর সিক্স সেন্সের কার্যকারীতা বাড়িয়ে দেবে। পাশাপাশি একজন উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ীর প্রতিনিয়ত স্ব-উন্নয়নমূলক তথ্য সর্ম্পকে জ্ঞান অন্বেষণ করা উচিৎ যা তাকে চাঙ্গা রাখবে যেকোনো পরিস্থিতিতে।

অনেকে বলেন, ‘দূরদৃষ্টির অভাবে’। একটি উদ্যোগ কিংবা ব্যবসায় দূরদৃষ্টি অনেক বেশি প্রয়োজন। যেখানে সারা বিশ্বেই ওয়্যারলেস ব্রডব্যান্ড সেবার ওয়াইম্যাক্স প্রযুক্তির ব্যবহার দিন দিন কমে আসছে সেখানে বাংলালায়ন বৈশ্বিক রেটের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি দামে স্পেকট্রাম কিনে ইন্টারনেট ব্যবসায় প্রবেশ করেছিল। ফলাফল লাইসেন্স হারিয়ে কোম্পানীটি আজ বিলুপ্ত। একটি দেশীয় উদ্যোগের সলিল সমাধী। একজন উদ্যোক্তা কিংবা ব্যবসায়ীকে শুধুই নিজের অফিসের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকলেই চলবে না। জানতে হবে ব্যবসার অসংখ্য নীতি।

অনেকের মতে বিশেষজ্ঞ ও স্টেকহোল্ডারদের সাবধানবাণী উপেক্ষা করে মেজর (অব.) আবদুল মান্নানের মালিকানাধীন সানম্যান গ্রুপের এই অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ২০০৮ সালে বৈশ্বিক রেটের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি দামে স্পেকট্রাম কিনে ইন্টারনেট ব্যবসায় প্রবেশ করে। তার প্রায় ১৪ বছর পর বিশেষজ্ঞদের সেই সতর্কবাণী ফলেছে। একে তো মাথার ওপর পাহাড়সম ঋণের বোঝা, তার ওপর বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) কাছে লাইসেন্স হারিয়েছে কোম্পানিটি।

সারা বিশ্বেই ওয়্যারলেস ব্রডব্যান্ড সেবার ওয়াইম্যাক্স প্রযুক্তির ব্যবহার দিন দিন কমে আসছে। এই ক্ষয়িষ্ণু প্রযুক্তিতে অবাস্তবভাবে বিশাল বিনিয়োগ করে এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে বাংলালায়ন কমিউনিকেশনস লিমিটেডের। এছাড়া এই পতনের জন্য বিশেষজ্ঞরা টেলিকম নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের দূরদর্শিতার অভাবকেও আংশিকভাবে দায়ী করেছেন।

মোবাইল অপারেটরগুলো এখন যে সেবা দেয়, সেই সেবা দেওয়ার উচ্চাশা নিয়ে লাইসেন্স নিয়েছিল ব্রডব্যান্ড ওয়্যারলেস অ্যাক্সেস বা ওয়াইম্যাক্স অপারেটরগুলো। উচ্চ মূল্যে স্পেকট্রাম এবং লাইসেন্স নিয়েছিল তারা, কিন্তু সে আশা তাদের পূরণ হয়নি।’

এছাড়াও চাহিদা অনুযায়ী প্রযুক্তি রূপান্তর করতে বাংলালায়ন ব্যর্থ হয়েছে । কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সাল পর্যন্ত বিটিআরসির কাছে বাংলালায়নের বকেয়া ছিল ২০০ কোটি টাকা।

বিটিআরসি থেকে রেকর্ড ২১৫ কোটি টাকায় ৩৫ মেগাহার্টজ (এমএইচজেড) স্পেকট্রাম কিনেছিল বাংলালায়ন, অথচ বিশ্বব্যাপী এই প্রযুক্তির স্পেকট্রামের সর্বোচ্চ মূল্য ছিল প্রায় ৮০ কোটি টাকা।

ব্যবসা স্থাপন করতে প্রতিষ্ঠানটিকে প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হয়েছে। এই টাকার মধ্যে ১৭১ কোটি টাকা দিয়েছে এবি ব্যাংকের নেতৃত্বাধীন নয়টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এক সিন্ডিকেট। এছাড়া কোম্পানিটি বন্ড ইস্যু করে ১৩০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে।

সে সময় টেলিযোগাযোগ ও আইসিটি বিশেষজ্ঞরা বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করেছিলেন যে, তৃতীয় প্রজন্মের (৩জি) প্রযুক্তির বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ওয়াইম্যাক্স প্রযুক্তি বিশ্বব্যাপী উঠে যেতে থাকায় এরকম মাত্রাতিরিক্ত বিনিয়োগ কোনো সুফল আনবে না। কিন্তু ওই সময় ৩জি প্রযুক্তি ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বিস্তৃত না হওয়ায় বিনিয়োগকারীরা ভেবেছিল উচ্চগতির ইন্টারনেটের ব্যাপক চাহিদা থাকবে। এ কারণে বিনিয়োগকারীরা সতর্কবার্তা ও সমালোচনা গ্রাহ্য করেনি।

বিটিআরসির তথ্যানুসারে, চালু হওয়ার পর প্রথম তিন বছরে অপারেটরটি নানা স্তরের মানুষ ও পেশাজীবীদের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়া পায়। এ সময় বাংলালায়নের গ্রাহক সংখ্যা সাড়ে ৩ লাখে পৌঁছায়।

কিন্তু মোবাইল ফোন অপারেটরগুলো ২০১৩ সালে দেশে ৩জি প্রযুক্তি চালু করার পর বাংলালায়নের স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। উপরন্তু সরবরাহকারীরা ওয়াইম্যাক্স প্রযুক্তি সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ায় প্রতিষ্ঠানটি এ প্রযুক্তির সরঞ্জাম পাচ্ছিল না।

অল্পদিনের মধ্যেই উচ্চাশা নিয়ে শুরু করা উদ্যোগটির অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে। অবশেষে নিয়মিত চার্জ ও ফি দিতে না পারায় ২০২১ সালে নিয়ন্ত্রক কমিশন বাংলালায়নের বিডব্লিউএ লাইসেন্স বাতিল করলে প্রতিষ্ঠানটির মৃত্যু ঘটে।

সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে, বকেয়া আদায়ে বিটিআরসি এখন কোম্পানিটির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে। অন্যদিকে খেলাপি হওয়া মোট ১৩৯ কোটি টাকা ঋণ পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে সিন্ডিকেট ঋণদাতাদের প্রধান এবি ব্যাংক বাংলালায়নের বন্ধকী সম্পত্তি বিক্রির জন্য নিলাম আহ্বান করেছে। ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন এই বিলুপ্ত কোম্পানিতে করা বিনিয়োগ পুনরুদ্ধার করতে বাংলালায়ন স্পনসরদের খুঁজছে।

ওয়াইম্যাক্স প্রযুক্তির মতো ক্ষয়িষ্ণু খাতে বিনিয়োগ করে বাংলালায়নের পতনের জন্য অনেকেই বিটিআরসিকে দায়ী করছেন। টেলিকম নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান অবশ্য নিজেদের দায় অস্বীকার করে বলেছে, বিনিয়োগের আগে ব্যবসার সম্ভাবনা যাচাই করা উদ্যোক্তার দায়িত্ব। কেউ বিনিয়োগ করলে তাকে ব্যবসায় টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের নয়।

তারপরও ওয়াইম্যাক্স অপারেটরগুলোকে এলটিই (লং-টার্ম ইভালুয়েশন) লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা সম্প্রসারণের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি। এদিকে ওয়াইম্যাক্স সেবাদাতারা মোবাইল অপারেটরগুলোর সঙ্গেও কাজ করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তা-ও করতে পারেনি।

বিশেষজ্ঞদের মতে , ইন্টারনেটের দুনিয়ায় প্রযুক্তির ব্যবহার প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে। ব্যবসায়ীরা সেই ঝুঁকি নিয়েই বিনিয়োগ করেন। প্রযুক্তির আধুনিকায়নের ফলে বিনিয়োগের লোকসানের অনেক উদাহরণ রয়েছে বিশ্বে। এটা মেনে নিতে হবে। তিনটি কোম্পানিকে মোট ১১০ মেগাহার্টজ স্পেকট্রাম বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে বাংলালায়ন ও কিউবিকে দেওয়া হয়েছিল যথাক্রমে ২৩০০ মেগাহার্টজ ও ২৫০০ মেগাহার্টজ। আর পরবর্তীতে ওলোকে ২৬০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডে ৪০ মেগাহার্টজ স্পেকট্রাম বরাদ্দ দেওয়া হয়।

বাংলালায়ন কমিউনিকেশনস লিমিটেডের পাশাপাশি কিউবি ব্র্যান্ড নামে সেবা দেওয়ার জন্য বিডব্লিউএ লাইসেন্স পেয়েছিল অগার ওয়্যারলেস ব্রডব্যান্ড বাংলাদেশ লিমিটেডও।

২০০৮ সালে কিউবিও ২১৫ কোটি টাকায় ৩৫ মেগাহার্টজ একটি স্পেকট্রাম কিনেছিল। পরবর্তীতে বাংলাদেশ ইন্টারনেট এক্সচেঞ্জ লিমিটেড ২০১৩ সালে ওলো নামে এবং ২০১৯ সালে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেড ব্র্যান্ড নামে বাজারে প্রবেশ করে।

বিটিআরসি কর্মকর্তারা জানান, এসব কোম্পানিও তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে, বর্তমানে তাদের কোনো কার্যক্রম নেই। সূত্র জানায়, ‘এরা লাইসেন্সের বিপরীতে নিয়মিত ফি ও চার্জ পরিশোধ করছে না, তাই কমিশন তাদের লাইসেন্স বাতিল করার পদক্ষেপ নেবে।’